অর্ধাঙ্গিনীঃ১ম পর্বঃ

অর্ধাঙ্গিনীঃ

১ম পর্বঃ
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি


জানালার পর্দা সরাতেই একঝলক রোদ সারার চোখের উপর পড়লো।সে চোখ কুঁচকেই চেঁচিয়ে উঠল-“এই আপি,জানালা বন্ধ কর্ না”!
-“উঁহুঁ,এবার তুই ওঠ,ঘড়ি দ্যাখ কটা বাজে।”
সারা এক চোখ বন্ধ রেখে এক চোখ দিয়ে বালিশের পাশে হাতড়ে মোবাইল বের করে সময় দেখল।তারপর লাফ দিয়ে উঠে বসল-“ওউ..শিট!”
জারা বিরক্ত হয়ে বলল-“এই,তোকে না হাজার বার বলেছি এসব শিট ফিট বলবিনা?বলবি,ইন্নালিল্লাহ”!!
সারা জবাব না দিয়ে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকল।বেরিয়ে গপগপ করে নাস্তা সারল।জারা প্রতিধাপেই ওকে বিভিন্ন নসীহা দিতে লাগলো।সারা কিছু শোনে কিছু শোনেনা।ওড়নাটা কোনোরকম মাথায় ছুঁইয়ে সারা বেরিয়ে গেল।এটুকুও করলো জারার চাপাচাপিতে।পথে বের হয়েই সে ওড়নাকে বর্তমান আধুনিকাদের মত করে পড়ে নিল।প্রতিদিন তাই করে।
.
টিএসসির সামনে রিক্সা দিয়ে নামতেই দুর থেকে সেজানকে দেখতে পেল।হোন্ডায় বসে আছে আর বারবার ঘড়ি দেখছে।সারা চপল পায়ে হেঁটে ওর কাছে গেল।
-“হাই”!
সেজান মুখ ফিরিয়ে সারাকে দেখে বলল-“এই তোমার নয়টা?”
সারা নিজের দুকান ধরে বলল-“স্যরি জান!অন্তত আজকের দিনে তুমি আমাকে বকোনা প্লিজ!”
সেজান কপট মুখ ভার করে সাথে সাথেই হেসে দিল-“চলো তাহলে?”
সারা বলল-” প্রথমে কোথায় যাবো?”
-“মমম(চিন্তার ভান করলো সেজান)প্রথমে খালামনির বাসায়!
-“তারপর কাজী অফিস?”
সেজান জবাব দিলোনা।হোন্ডা স্টার্ট দিলে সারা উঠে বসল।বাতাসকে ছাপিয়ে হোন্ডা তীব্র বেগে চলতে লাগলো!

একটা বিলাসবহুল বাড়ীর গেটে হোন্ডা থামল।সারা নেমে বাড়ীটা দেখতে লাগলো বিস্মিতভাবে।সেজান ওর হাত ধরল-“চলো”!
সারা নড়লোনা।সেজান অবাক হয়ে বলল-“কি হলো রে ভাই?”
-“বাসায় কে কে আছে?”
-“গেলেই দেখবে।চলো।”
ইতস্তত করে পা বাড়ালো সারা।কলিং বেল বাজলে বুয়া দরজা খুলে দিল,সেজানকে সালাম দিলো।সেজান জিজ্ঞেস করল-“খালামনি কই?”
-“খালাম্মা তো গত পরশু ইন্ডিয়া গেছে।আর ফাহিম ভাই বাসাত নাই”!
-“সেজান হতাশার ভঙ্গি করল-“ওহ্ হো,কি করি,আচ্ছা আমরা বসি!”
বুয়া ভেতরে চলে গেল।সারা বলল-” চলো চলে যাই”!
সেজান বলল-” আরে দেখিনা,ফাহিমকে ফোন দেই,ও যদি আসে”!
-” না না চলো তো!তোমার খালামনি নেই,ফাহিম ভাইকে দিয়ে কি করবো”!
-“আরে কেউ নেই তো কি,এটা আমার নিজের বাড়ীর মতো।আর তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করোনা?”
-” তা করি”সারা আমতা আমতা করতে লাগল।সেজান দৃঢ় ভাবে বলল-“শোনো,আমার জন্য সারা দুনিয়ার মেয়েরা পাগল।আর আমি পাগল তোমার জন্য।নইলে যাকে তাকে কি ফ্যামিলিতে নিয়ে আসি?”
সারা আর কিছু বলল না।
এভাবে প্রতিবারই সেজানের জেদ ভরা যুক্তি তর্কের কাছে সারা হেরে যায়।হারিয়ে ফেলে নিজের অস্তিত্ব।

কিছুদিন পরের কথা! এক বিকেলে সারা সেজানকে ফোন দেয়,জরুরী ভিত্তিতে পরদিন দেখা করার জন্য!”
সেজান দেখা করতে আসে।সারার চেহারাটা আজ ক্লান্ত মনে হচ্ছে! সেজান ওর গাল ধরে বলে,”কি জান,হঠাৎ আর্জেন্ট কল দিলা?”
সারা মুখ নিচু করে রেখে কিছু ভাবল।তারপর বলল-“তুমি আজই আমাকে কাজী অফিস নিয়ে চলো প্লিজ।আমরা আজই বিয়ে করবো!
সেজান থমকে যায় প্রথমে তারপর বলে-“বাট আজ তো আমার কাজ আছে….!তাছাড়া আজই কেন?”
সারা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে ওঠে-“আজ আজ ককরে ককদিন হলো! ওসব আমি জানিনা,হয় আজ তুমি আমাকে বিয়ে করবে নয়তো আজ তোমার চোখের সামনে রাস্তায় জান দেবো আমি”!
সেজান ওকে সামান্য ঝাঁকি দিলো,”এ্যাই,কি হয়েছে তোমার বলো তো!”
সারা অসহিষ্ণু কন্ঠে বলল-“লেটস গো টু দ্যা কাজী অফিস”!বলে সে বাইকে উঠে বসল।সেজান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাইক স্টার্ট দিলো।ধানমন্ডি কাজী অফিসের সামনে এসে বাইক থামালো!
কাজী অফিসের গেটে হাসাণ, পাপন,মিরা আর তুলিকে দেখে অবাক হলো,”তোরা সব এখানে?’
তুলি সেজানের পিঠে চাপড় মেরে বলল-“শালা তুমি একলা বিয়া করবা আমগো ফালায়া।সারা না বললে তো মিস করতাম।”চল্,এখন।”!
সারা এবার হাসছে।ওকে কিছুটা নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে এবার।সেজান এবার আর পাশ কাটাতে পারলোনা।সারা আজ আটঘাট বেঁধে এসেছে।পরিস্থিতির কারনে বন্ধুদের চাপে পড়ে অবশেষে সেজান সারাকে বিয়ে করলো।মোহরানা নিয়ে সারা কিছু বলল না,বন্ধুরাই বলল-“ব্যাটা তুই কোটিপতির পোলা।দশ লাখ টাকা কাবিন দে”!
সেজান কৌশলে সেটাকে দুইলাখে নামিয়ে আনল।বলল যে মনটাই আসল,টাকাপয়সা দিয়ে সংসার হয়না,ইত্যাদী।

বিয়ে শেষে সবাইকে চাইনিজ খাওয়াতে হলো সেজানের।সারা আজ খুব খুশি।জারাকে কি বলবে সেটা নিয়ে একটু ভাবছে তবে চিন্তাটা ওর মাথা থেকে নেমে গেছে।ও মনে করছে বিয়ে করে সেজানকে ও আটকে ফেলেছে।সমাজের বোকা আবেগী মেয়েগুলো এইভাবেই নিজেদেরকে সস্তায় দান করে দেয় প্রেমিকরূপী লম্পটদের হাতে।
সন্ধ্যায় বাড়ী ফেরার পথে সারা সেজানকে বলে-“তোমার বাসায় কবে জানাবে?”
-“আরে এখন না, আচ্ছা,তুমি এতো অস্থির হচ্ছো কেন বলতো”!
সারা নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল-” আমার শরীরটা ভালো না,দুতিনবার বমি হয়েছে।তাছাড়া….!
-“আরে দুউর,তুমি যা ভাবছো তা তো নাও হতে পারে।ওহ্,ইয়েস,তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি! কাল আমি চিটাগং যেতে পারি! যদি যাই,আই’ল কল ইউ”!
-“বাই”!

সারা বাসায় ফিরল।সাতশো আটশো স্কয়ার ফিটের এই বাসাটাতে সারা আর জারা দুবোন থাকে।ওদের সাথে ওদের এক ফুপি থাকে।জারার মা নেই,বাবা সৌদী থাকেন।সেখানে চাকরি করেন।মাঝেমধ্যে দেশে এসে দুমেয়েকে দেখে যান।ওদের সাথে তিনি তার দুঃসম্পর্কের এক বিধবা বোনকে রেখেছেন যে ওদের সাথে সবসময় থাকে।
জারা সারার বড় বোন এবং সম্পূর্ণ সারার বিপরীত।সারা চঞ্চল,ছটফটে,জেদী আর স্বেচ্ছাচারী অথচ জারা শান্ত ভদ্র ধার্মিক ও খুব ঘরোয়া মনের।দুবোনে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও জারা ছোট বোনকে খুবই ভালোবাসে,বিশ্বাস করে।যদিও সারার খোলামেলা জীবনাচরণ সারার একদম পছন্দ না।তবু সাধ্যমতো চেষ্টা করে বোনকে বোঝাতে।মা নেই বলে ছোটবোনকে বেশী আদর করে তাকে বাঁদর বানানো হয়ে গেছে এটা বোঝে জারা।

মাসখানেকের মধ্যে সারার শারিরীক অসুস্থতা জারাকে বিচলিত করে তোলে।জোর করে বোনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় আর তখনি জারার মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হয়।ডাক্তার জানায় সারা প্রেগন্যান্ট।আরো যা যা বলে তা জারার কানে ঢোকেনা।মন্ত্রমুগ্ধের মত বাড়ী এসে নিঃশব্দে মাটিতে বসে পড়ে গুটিসুটি মেরে।দেখে মনে হয় ভীষণ ভয় পেয়েছে।সারা ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বলে-“আপু,স্যরি তোমাকে বলব বলব করেও বলা হয়নি যে আমরা বিয়ে করেছি,তুমি ভেবোনা,আমি বিবাহিত!”
জারা নিরবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।কষে চড় মেরে ওর গালটা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে,ও কি জানে? ও নিজের ওপর কতবড় জুলুম করেছে?”
জারাকে চুপ দেখে নিজেই বলল-“জানি তুমি ভয় পাচ্ছো!,কিন্তু ভয় পেয়োনা,আমি সেজানকে বাধ্য করবো আমাকে ইমিডিয়েট তুলে নিতে!”
জারা জানে সামনে একটা বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।বাবাকে ফোনে জানাবে কি না ভাবছে!কিভাবে কি বলবে মাথা কাজ করছেনা।বাবা যদি শুনে অসুস্থ হয়ে পড়ে?”
.
সেদিন সারা বাড়ী ফিরলে জারা ওকে ধরে-“কি বলল সেজান ?কবে নিতে আসবে তোকে?”
সারা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।জারা জমে শক্ত হয়ে গেল।যা বোঝার বুঝে গেছে ও।সারারাত সারা মড়ার মত ঘুমালো আর জারা নামাজে কাঁদল।সকালে আলমারী খুলে ভালো বোরকাটা বের করলো।সারা জানতে চাইলো -“কোথায় যাচ্ছো আপু?”
জারা বলল-” তুই সেজানদের বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা আমাকে দে!”
সারা অবাক হয়ে বলল-“তুই ওদের বাসায় যাবি?”
-“হুঁ…ওর গার্জিয়ানের সাথে কথা বলবো।কে কে আছে ওর?”
-“ওরা দুই ভাই,ওর এক বড় ভাই তিনি ব্যবসা করেন আর ওর মা। ওদের বাসা ইস্কাটন।”
জারা আল্লাহর নাম নিয়ে বের হলো।সারাপথ আল্লাহর কাছছে দুআ চাইল-“তিনি যেন সব সহজ করে দেন”!
বড় একটা গেটের কাছে রিক্সা থামল।গেটের দারোয়ান আটকে জিজ্ঞেস করল-“কার কাছে যাবে”!
জারা সেজানের মা’র কাছে যাবে বলল।দারোয়ান জানালো -“উনি তো বাসায় নেই!খালি আফনান ভাইয়া আছে।”!
জারা বলল-“আচ্ছা,আমি ওনার সাথেই কথা বলবো!”
সুন্দর করে সাজানো ড্রইং রুমে বসে আছে জারা।নেকাবটা ভালো করে টেনে বসলো।খুব বাধ্য না হলে সে পরপুরুষের সাথে কথা বলা পছন্দ করেনা কিন্তু এখন যেহেতু সেজানের মা নেই তাই বাধ্য হয়ে ওর বড়ভাইয়ের সাথেই কথা বলতে হবে!”
মাথা নিচু করে সাত পাঁচ ভাবছে জারা।তখনি ঘরে প্রবেশ করলেন এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক।বেশ লম্বা, আর উজ্জল শ্যামলা,গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ী।হালকা মেরুন রঙের গেন্জী আর সাদা ট্রাউজার পরনে।জারা মাথা নিচু করে থাকায় প্রথমে পায়ের দিকে চোখ গেল।কিছুটা অবাক এবং খুশি হলো এটা দেখে যে ভদ্রলোক ট্রাউজার টাখনুর অনেকখানি ওপরে পড়েছেন।জারা মৃদু স্বরে সালাম দিলে তিনি তাকিয়ে চমকে গেলেন কিছুটা।
দারোয়ান বলেছিল যে কোন এক মহিলা দেখা করতে এসেছে কিন্তু সে যে এরকম পূর্ণ হিজাবী তা তো বলেনি।আফনান সালামের জবাব দিয়ে কিছুটা দুরত্ব রেখে বসে বললেন-“জ্বী,বলুন”!
জারা সংকোচে কিছুক্ষণ চুপ থাকল।সে ভেবেছিলো সেজানের মা’র সাথে কথা হবে।এখানে তো বড়ভাই হাজির।কি বলবে কিভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।অবশেষে লজ্জা জড়োসরো কন্ঠে খুব বেছে বেছে যথাসম্ভব শালীন ভাষায় কথাগুলো বলার চেষ্ষ্টা করল।আফনান নিরবে শুনে গেলেন।জারা একঝলক তাকিয়ে দেখলো ভদ্রলোকের মুখ লাল হয়ে গেছে।জারা বলতে গিয়ে শেষের দিকে কেঁদে ফেললে আফনান অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন।জারা মৃদুস্বরে বলল-“আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন তো?”
আফনান জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লেন।জারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেল।আফনান কিছুক্ষণ ভেবে তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-“আপনাদের বাসাটা কোথায় জানতে পারি?”
জারা ঠিকানা বলল।আফনান জানালো-“সে দুতিনদিন পর যোগাযোগ করবে।মা আসুক।তারপর জারাকে অভয় দিয়ে বললেন-“আপনি ভয় পাবেননা।সারাকে তার অধিকার দেয়া হবে।আমি সেজানের সাথে কথা বলবো।আপনার নামটা ?
জারা নেকাবের মাঝ দিয়ে তাকালো -“আমার নাম জারা”!
আফনান কেবল একজোড়া ভেজা চোখ দেখতে পেল।অদ্ভুত একজোড়া চোখ যার বাম চোখের পাশে একটা বড় তিল।চেহারা না দেখলেও ঐ তিল দেখেই সে জারাকে চিনে নিতে পারবে।
জারা বিদায় নিয়ে চলে আসল।আফনান ভদ্রতা করে উঠে দাঁড়ালো তারপর জারা বেরিয়ে যাবার পর মোবাইলে নাম্বার চাপল।
জারা সারাপথ ভাবতে ভাবতে এল-“যার বড় ভাই এমন তার ছোট ভাই এমন অসভ্য কেন?”
….

চলবে….

hassab_irsf

সংগ্রহ:-https://www.facebook.com/golpo.bhandar72/


Comments

One response to “অর্ধাঙ্গিনীঃ১ম পর্বঃ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *