অর্ধাঙ্গিনীঃ৭ম পর্ব

অর্ধাঙ্গিনীঃ

৭ম পর্বঃ
মোর্শেদা খাতুন।
…..♥♥♥……
.

আফনান ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল-“তুমি আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা!!
জারা ওকে বলল-“চলুন,রাত বাড়ছে!” ওরা ভেতরে চলে এল।কিছুক্ষণ পর দুজনে খেতে বসল।
জারা বলল-“কোনো জরুরী কাজ ছিল আজকে??
-“আরে আর বোলোনা,ব্যবসায়িক কাজেই একজনের সাথে হঠাৎ মিটিং ফিক্সড হলো,উনি ঢাকা যেতেন কিন্তু আমি সিলেটে আছি শুনে অনুরোধ করল মিটিংটা এখানেই সেরে নেবার জন্য।এর মধ্যে আবার মিটিং চলাকালে একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে,ওকে হাসপাতালে পৌঁছে দিলাম,চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হলো,এসব করতে করতে কখন যে এত রাত হয়ে গেল টেরই পাইনি।শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে’”।
জারা বলল-“খেয়ে বিশ্রাম নিন,চায়ের কথা বলবো জাকিয়াকে?”
আফনান বলল-“হ্যাঁ,বলো! ভালো কথা,জাকিয়া সব ঠিকমতো করে দিচ্ছে তো?”আমি প্রথমেই ওদের বলে দিয়েছি কোন পুরুষ ওয়েটার যেন ৩০১-২ তে না আসে।”
-“ও,এজন্যই শুধু মেয়েরাই আসে।জাকিয়া মেয়েটাই বেশী আসে, মাঝেমাঝে কিন্নরী নামে একটা মেয়ে আসে।”
-” জারা,চা টা বারান্দায় দিতে বোলো”!
-“সে কি আবার বারান্দায় বসবেন?ঘুমাবেন না? আপনি তো ক্লান্ত!” জারা গ্লাসে পানি ঢেলে আফনানের দিকে এগিয়ে দিল।
-“তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ক্লান্তি কেটে গেছে”।বলে আফনান পানির গ্লাসটা সরিয়ে বলল-“তুমি কোন গ্লাসে পানি খেয়েছো?”
জারা কিছুটা অবাক হয়ে ওর আধাখাওয়া পানির গ্লাসটা আঙ্গুল তুলে দেখাল।
আফনান হাত বাড়িয়ে সেটা নিল তারপর গ্লাস ঘুরিয়ে দেখে যে জায়গাটা দিয়ে জারা পানি পান করেছে বলে ধারনা হলো সে স্থান দিয়ে বাকি পানিটুকু পান করল।
জারা তাকিয়ে আছে দেখে বলল-“সুন্নত আমিও কিছু কিছু জানি আলহামদুলিল্লাহ।আজ এই সুন্নতটার উপর আমল করার সুযোগ আল্লাহতা’লা আমাকে করে দিলেন।”
জারা এবার হাসল।আফনান বলল-“তুমি তো নিশ্চয়ই জানতে এটা?”
-“জ্বী, জানতাম।মা আঈষা রাঃ পাত্রের যে স্থানে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন রাসুল সাঃ ঠিক সেই স্থানে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন।”
-“আবার মা আঈষার গোস্তের আধখাওয়া টুকরো রাসুল সাঃ নিয়ে খেতেন,ঠিক না?”আফনান বলল।
-“জ্বী,ঠিক!”
আমি গুনে গুনে সবগুলো সুন্নত পালন করতে চেষ্টা করবো ,ইনশাআল্লাহ।দাম্পত্য জীবনে রাসুল সাঃ এর বেশ কিছু চমৎকার সুন্নত আমি পড়েছি।”
জারা ঠোঁট মুড়ে হাসল-“সত্যি,তিনি স্বামী হিসেবেও ছিলেন অসাধারন।এটা তাঁর স্ত্রীদের ভাষ্য”!
.
আফনান কিছু বলতে যাবে তখনি বেল বাজল।আফনান ইশারা করল-“যাও,দ্যাখো!,তোমার জাকিয়া এসেছে।”
জাকিয়া চা দিয়ে সব প্লেট বাটি নিয়ে গেল।কাপগুলো সকালে নিবে বলে জানালো।সকালে নাস্তা কখন দেবে তাও জিজ্ঞেস করল।জারা ফুপুর ঘরে আটটার দিকে নাস্তা দিয়ে দিতে বলল আর তাদেরটা যখন কল দিবে তখন দিতে বলল।
জারা চা নিয়ে বারান্দায় এলো,আফনানের হাতে চা দিয়ে নিজেও পাশের চেয়ারে বসল।আফনান পাশের চেয়ারটা জারাসহ টেনে নিজের চেয়ারের পাশে লাগিয়ে বলল–” এতো দুরে বসেছো কেন?””
জারা দুষ্টুমি করে বলল-“দুর যত মধু তত”!
আফনান চমকে সোজা হয়ে বসল-“উরিব্বাবা,তুমি তো ভালো কবিতাও জানো দেখছি!
“,কিন্তু মাননীয়া,এটা জানেন কি? স্বামী যখন স্ত্রীকে তার কাছে ডাকে তখন স্ত্রী যদি না আসে তবে ফেরেস্তারা সারারাত লানত করতে থাকে?”.
জারা আফনানের মুখের উপর হাত রেখে বলল–“প্লিজ…,থামুন!”
আফনান ওর হাত ধরে ফেলল,তারপর তাতে চুমু খেয়ে বলল–“তোমার কাছাকাছি আসলে আমার পালপিটেশন বেড়ে যায় এটা সত্য তবে আমি চাই তুমি ভালোবেসেই আমাকে একদিন ডাকবে,আমি ঠিক সেদিনেরই অপেক্ষা করছি”!
জারা মৃদু স্বরে বলল-“ক’টা বাজে?”
আফনান ঘড়ি দেখলো-” সোয়া দুইটা বাজে,কেন তোমার ঘুম পাচ্ছে?”
জারা মাথা নেড়ে না বলল।আফনান ওর হাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল-” কাল তো ঢাকা চলে যাবো,তারপর শুরু হবে ব্যস্ততা,তোমার সাথে এভাবে রাত জেগে গল্প করার সুযোগ আবার কবে পাবো জানি না!”
জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনার মত স্বামী পেয়েছি কিন্তু কি জানেন,সারার স্মৃতি আমাকে সারাক্ষণ কাঁদাচ্ছে।আমি আপনাকে আপনার প্রাপ্য অধিকার দিতে পারছিনা,সারার চেহারা বারবার আমার চেতনায় হানা দিচ্ছে….আমাকে ক্ষমা করবেন,প্লিজ…..!”
আফনান মৃদু হাসলো-“আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসেছি একসময় পরিস্থিতিই আমাদের কাছে এনে দেবে।এই যে,চুটিয়ে রোম্যান্স করছি তোমার সাথে এটা কি কম? মাঝে মধ্যে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি…….জারা বাতাসের শব্দে হেসে উঠল।
এভাবে গল্পে আড্ডায় সুন্নতের আলোচনায় খুনসুটিতে ওদের সময়গুলো কেটে গেল।ভোরের আযান শুনে দুজনই উঠে পড়ল।


ফুপু এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসতে চেয়েছিলেন।জারাই নিষেধ করল।যাবার সময় ফুপু অনেক কাঁদলেন–“মা ‘রে বাচ্চা নিয়ে সংসার একা কিভাবে সামলাবি ভেবেই চিন্তা হচ্ছে।জামাই তো আমাকে মোবাইল কিনে দিলো, সময় পেলেই ফোন দিবি,কেমন?
জারা ফুপুর চোখ মুছে দিয়ে বলেছে-“তুমি কেমন আছো জানিও ফুপি।”ফুপি কন্যাসম ভাতিজীকে জড়িয়ে ধরলেন।
প্লেনেও জারার মনটা কিছুটা খারাপ ছিল।পাশাপাশি নতুন সংসার নতুন শ্বশুড়বাড়ীর পরিবেশ কেমন হবে এসব ভেবেও কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিল যদিও ওর শ্বাশুড়ী দেশে নেই।

আফনান সম্ভবত আগে থেকেই বলে রেখেছিল।কাজের লোকজন গাড়ীর হর্ণ পেয়েই ছুটে এল।আফনান ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করল–“খালামণি কোথায়?”
ঠিক তখনি পেছন থেকে একজন মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন।গোলগাল চেহারা হাসিখুশি মুখ।জারাকে আপাদমস্তক বোরকাবৃতা দেখে খানিকটা থমকে গেলেও দ্রুত সামলে নিলেন।জারাকে দেখিয়ে আফনানকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন -‘এটাই? ‘ আফনান হাসল।খালামণি জারাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন।জারা মৃদুস্বরে সালাম দিল।–“এসো মা,’বলে জারার কোলের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আরেকহাতে জারাকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।ড্রইংরুমটা দেখে পেছনের একটি দিনের কথা মনে পড়ে গেল জারার।খালামণি জারাকে একেবারে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলেন-“তোমার জন্য আমাদের ফিন পুরো বাড়ীর পরিবেশটাই বদলে ফেলেছে।তুমি পর্দা করো বলে তোমার রুমটা ভেতরের দিকে নেয়া হয়েছে,ওদিকটায় বাথরুম ছিলোনা বুঝলে নতুণ বাথরুম করা হয়েছে।আফনান যে কি পাগল,কি রেখে কি করবে,ওকে এত এক্সাইটেড কখনো দেখিনি,ফোনে আমাকে আর ওর খালুকে পাগল করে ছেড়েছে।খালামণি এমন করবে,অমন করবে।কি করবো বলো,আপা দেশে নেই, সেজানটাকে নিয়ে……. খালামণি হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন।কথা বলতে বলতে তিনি ভুলেই গেছিলেন যে জারাকে বিয়ের ব্যাপারে সেজানের একটা ভূমিকা রয়েছে।ঘরে পৌঁছে বললেন-“এই হলো তোমার ঘর,তোমার সংসার…নাও এবার বোরকাটা খোলো তো তোমাকে দেখি!
জারা নম্র ভঙ্গিতে বোরকার নেকাব সরালো।তারপর বোরকা খোলার আগে খালামনিকে জিজ্ঞেস করল-“কেউ আসবেনা তো এদিকে?”এদিকে খালামনি পলকহীন চোখে জারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন,তারপর জারার প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলে বললেন-“মাশাল্লা,মাশাল্লা, আমাদের আফনানের পছন্দের তারিফ করতে হয়।জারা লজ্জা এড়াতে বলল-“আপনাকে আমি খালামনি বলতে পারবো?”
–“হ্যাঁ,হ্যাঁ,আমি আমার সব ভাগনে ভাগনির ফেভরিট খালামনি”!
-“খালামনি,আমি আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করিনি বলে রাগ করবেন না,প্লিজ।কারন ইসলামে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে মাথা নোয়াতে নেই তাই আমি……!”
-“আরে ও কিছুনা,মা,তুমি আগে জামাকাপড় ছাড়ো ফ্রেশ হও।এতদুর জার্ণি করেছো।বলে”এ্যাই কমলা” বলে চেঁচিয়ে এক কাজের মেয়েকে ডাকলেন।কমলা এসে দাঁড়াল।জারা দেখলো একটা কম বয়সী হালকা পাতলা গড়নের মেয়ে, খুব হাসিখুশি মুখ।জারার দিকে তাকিয়ে হাত তুলে সালাম দিলো-“সালামালাইকুম মামী”!
জারা হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল-“ওয়াআলাইকুমুসসালাম।”
মেয়েটা খালামনির দিকে তাকিয়ে বলল-“নানী,মামী কি সোন্দর দ্যাকসেন?”
খালামনি হেসে বলল–“হ্যাঁ,হ্যাঁ,মামির কাছাকাছি থাকবি তুই।মামি যা বলে করে দিবি,ঠিকআছে?” কমলা সোৎসাহে মাথা নাড়ল।তারপর খালামনির কাছে গিয়ে বলল-“বাবুরে এট্টু নিমু!”
খালামনি ওর কোলে বাচ্চাকে দিয়য়ে সতর্ক করে বললেন-“সাবধানে নিবি,দেখিস বাবুর ঘুম না ভাঙ্গে।”
তারপর জারার দিকে তাকিয়ে বলল-“তুমি ফ্রেশ হও মা,আমি ওদিকটা দেখে আসি।আরে তোমরা আসবে বলে আফনান আমাকে থাকতে বলেছে।সে তো আমাকে বলে-“কেউ না থাকলে আমার বৌ কে গ্রহন করবে কে?আম্মা বাসায় নেই! তোমাকে থাকতেই হবে।ও যা জেদী ওরে বাবা,আমি না এলে ও আমাকে আস্ত রাখবেনা!”
-“বসুন না খালামনি!”
-“না মা, আজ বসবো না,কাল তো আবার আসবোই।তখন কথথা হবে।চলি কেমন?”
জারা সালাম দিয়ে তাঁকে এগিয়ে দিল।
জারা এবার পুরো ঘরটা দেখলো।বেশ বড় রুমটা।পাশেই খোলা চওড়া বারান্দা।ঘরটাতে চারদিক ছড়িয়ে বিভিন্ন আসবাব রাখা হয়েছে।জারা কমলাকে ইশারায় ডেকে বলল-“তোমার মামা কোথায়?”
-“মনে হয় বাইরের ঘরে,ডাক দিবো মামী! “
-“একটু ডেকে আনতো মা।”বলে বাবুকে নিজের কোলে নিল জারা।কমলা দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল।জারা বাবুকে হালকা দোল দিয়ে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিল।সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠল।
হঠাৎ পেছন থেকে আফনানের কথায় চমকে উঠল-“কেমন লাগছে এখানে ?”
জারা ওকে ছাড়িয়ে বলল-“আলহামদুলিল্লাহ! বিশেষ করে খালামনিকে তো বেশ ভালো লেগেছে,উনি খুবই আন্তরিক।”
আফনান ওর হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল-“তোমাকে আমার ঘরে আনতে পেরে আমি নিজে খুব আনন্দিত ! ওহ্,আরেকটা সুসংববাদ।আগামী শনিবার তোমার শ্বাশুড়ী দেশে ফিরছেন।সেজান আসবেনা,সে ওখানেই চিকিৎসাধীন থাকবে।আরো খুশির কথা হলো আম্মাকে তোমার কথা বলেছি।আম্মা প্রথমে একটু চমকে গেলেও পরে খুব খুশি হয়েছে।আজ আমি অনেক খুশি!”
..♥..
সিলেট থেকে আসার পর থেকে আফনান প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।নাস্তা খেয়ে বেরোয়,কোনোদিন লাঞ্চ করতে বাড়ী আসে কোনদিন অফিসেই সেরে নেয়!”
জারার বাবুকে নিয়েই সময় কাটে।কমলার সাথে গল্প করে।কমলাই আজ বলল-“বড় নানু যে কি রাগী!””
জারা বুঝলো ও আফনানের মা’র কথাই বলছে।কাল তিনি আসবেন।তাই বাড়ী ধোয়া মোছার কাজও জোরেশোরে চলছে।কমলাকেও খুব তটস্থ মনে হলো।জারার টেনশন বাড়ছে।কাল কখন আসবে কে জানে !আফনান অফিসে।এমন সময় গাড়ীর শব্দ এলো।বাইরে মৃদু গুন্জন শোনা গেল।কে এল এসময়ে? আফনান ফিরতে ফিরতে তো রাত!”
জারা সাতপাঁচ ভাবছে।এমন সময় হালকা ঘিয়ে রঙের শাড়ী পড়া, লম্বা ও খুব ফর্সামত একজন মহিলা ঢুকলেন।মাঝখানে সিঁথি দিয়ে চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো,একপাশে সাদাচুলগুলো এমনভাবে আঁচড়ানো যে দেখলে ইন্দিরা গান্ধীর কথা মনে পড়ে।জারা সালাম দিলে তিনি সালামের জবাব না দিয়ে জারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বললেন-“তুমিই তাহলে সেই মেয়ে?”
জারা তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো! তিনি পুনরায় দাঁতে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন-“এই রূপ দেখিয়েই তাহলে আমার ছেলের মাথাটা খেয়েছো…তাই না?”
জারা অবাক হয়ে ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইল।ভাছে,ইনি নিশ্চয়ই আফনানের মা! কিন্তু ওনার তো আগামীকাল আসার কথা,উনি আজই চলে আসলেন।!?

চলবে…..

hassab_irsf


Comments

One response to “অর্ধাঙ্গিনীঃ৭ম পর্ব”

  1. […] Chapter 2 Chapter 3 Chapter 4 Chapter 5 Chapter 6 Chapter 7 Chapter 8 Chapter 9 Chapter […]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *