অর্ধাঙ্গিনীঃ♥১১ পর্ব

অর্ধাঙ্গিনীঃ

♥১১ পর্বঃ
লেখাঃ-মোর্শেদা হোসেন রুবি


আফনান দ্রুত হাতে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল।ওর মাথায় নানান ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।এমন সময় সাবিহা চৌধুরী ঘরে প্রবেশ করে হতবাক হলেন।বিছানার উপর আফনানের কাপড় চোপড় এলোমেলো পড়ে আছে।পাশেই একটা ব্যাগ তাতে কিছু কাপড় উঁকি দিচ্ছে।সাবিহা অবাক হয়ে বললেন-“তুই কি করছিস এসব?ব্যাগ গুছাচ্ছিস কেন?
-“ওহ্,আম্মু তুমি এসেছো,আমি একটু সিলেট যাচ্ছি,এই আধা ঘন্টার মধ্যেই রওয়ানা দেবো।বাই রোড।”
-“তুই কি পাগল হলি নাকি? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? এই রাতের বেলা তোর সিলেট যাবার কি দরকার পড়লো,তাও বাই রোডে?”
আফনান ঘুরে মা’র দিকে তাকাল।হাত ধরে বলল-“আমাকে একটু সময় দাও।আমি তোমাকে সব বলবো,আগে তোমার বৌমাকে নিয়ে আসি তারপর তুমি সবই জানবে!”
সাবিহা বিস্মিত হলেন-“বৌমা সিলেটে?”
-“হমম…”
-“তুই কিভাবে জানলি?”
-“ওহ্,মা…..প্লিজ আমাকে কোনো প্রশ্ন কোরোনা আর এদিকেও সবাইকে আপাতত কিছু বোলোনা। আমি এসে নেই তারপর কথা হবে।”
সাবিহা বুঝতে পারছেন,ছেলে জারার কাছে যাবার জন্য উতলা হয়ে আছে।তবু বললেন-“বাই রোডে যেতে তো অনেক সময় লাগবে,রিস্কিও।বাই এয়ারে যা!”
-“না,আমি রোডেই যাবো,তুমি ভেবোনা,পৌঁছে তোমাকে জানাবো।বাট নাউ স্পিকটি নট,ওকে?”
আফনান দুহাতে হিপ পকেট চেক করল।তারপর মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল।সাবিহা চিন্তিত মুখে ওর পেছন পেছন গেলেন।

গাড়ী মসৃন গতিতে চলতে লাগল।আফনান মাথাটা পেছনে হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে।ক্লান্তি দুশ্চিন্তা অস্থিরতা ওকে একেবারে কাবু করে ফেলেছে।মাঝরাতে ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে জানতে চাইল আফনান খাবে কিনা বা অন্যকিছু নেবে কিনা??আফনান খাবেনা বলে ড্রাইভারকে যেয়ে খেয়ে আসতে বলল।শেষ রাতের আলো ফোটার আগে আগে ওরা সিলেট পৌঁছালো।
আফনান জিজ্ঞেস করলো-“আপনি চেনেন বাসাটা?”
-“জ্বী, সাহেব।”
-“তাহলে…নিয়ে চলুন সেখানে!”
-“একটা ফোন করে বলে দিবো আমাদের আসার কথা?”
-“ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে?”
-“জ্বী।”
আফনান একটু ভেবে বলল-“আপনি এক কাজ করুন।আমাকে ঐ বাসায় নামিয়ে দিয়ে আপনি হোটেলে চলে যান।আমার জন্য রুম বুক করুন তারপর আমাদের নিতে এখানে চলে আসবেন।”
-“জ্বী,আচ্ছা।”
..
যখন ভোরের আলো ফুটে গেছে তখন আফনানের গাড়ী একটা ছোট দোতলা বাড়ীর সামনে পৌঁছুল।সে নেমে গাড়ী ছেড়ে দিল।বুকের ভেতর অস্থির হ্রদয় যেন চিৎকার করে বলছে- “ভালবাসি,ভালবাসি”!

কিছুটা দ্বিধা করে ডোরবেল টিপল আফনান।ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলোনা।আরেকবার বাজাতেই জারার ফুপি দরোজা খুলে দিলেন!”
তারপর আফনানকে দেখে ওনার চোখ বিস্ফোরিত হবার যোগাড়।বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রায়-“,বাবা,আপনি?”
-“মাফ করবেন,সকালবেলা বিরক্ত করে ফেললাম’”!
-“আরে না না,আসুন বসুন”!
ফুপি আফনানকে বসতে বলে প্রায় দৌড়ে ভেতরে গেলেন!
.
আফনান একটা সোফায় বসতে যাবে তখনি জারা প্রবেশ করল-“আপনি এসেছেন?
আফনান না বসে দাঁড়িয়ে গেল।অপলক চোখে জারার দিকে তাকিয়ে রইল।যেন কত বছর পর দেখছে।জারার চোখে পানি ভরে গেল।সে প্রায় ছুটে এসে আফনানকে জড়িয়ে ধরল।আফনানও স্থান কাল পাত্র ভুলে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তারপর ওর মাথার ঠিক মাঝখানে চুমু খেয়ে বলল-“যাও,দশ মিনিটে চটপট তৈরী হয়ে এসো।আমার সাথে যাবে।”
ভেজা চোখ তুলে আফনানের দিকে তাকিয়ে বলল-“কোথায় যাবো?”
আফনান সেই ভেজা চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল।তারপর বলল-“আমার যেখানে খুশি নিয়ে যাবো,আপত্তি আছে?”
জারা মাথা নেড়ে আফনানের বুকে মাথা রাখল।আফনান ওকে মৃদু ঠেলা দিয়ে বলল-“যাও যাও,তৈরী হও,আমি কিন্তু সারারাত ঘুমাইনি,কিছু খাইওনি।”
-“সে কি? আমি নাস্তা তৈরী করে নিয়ে আসি”?
-“উহুঁ…উহুঁ…আপনি রেডি হন।বেরুবো।””
-“বাবুকে তৈরী করতে একটু সময় লাগবে যে,ও তো ঘুমে!”
-“বাবু আপাতত এখানে ফুপির কাছেই থাকুক।আমরা দুপুরের আগে এসে বাবুকে নিয়ে যাবো,ফুপি সহ “!
জারা কিছু বলতে যাবে তখন ফুপি একটা ট্রে হাতে ঢুকলেন।তাতে শরবত আর কিছু ফল।
আফনান লজ্জা পেল কিছুটা-“ফুপিকে সকাল সকাল বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।আপনি ব্যস্ত হবেননা ফুপি,বসুন আপনার সাথে একটু কথা বলি।”ফুপি বসলেন।আফনান শান্তস্বরে বলল-“আপনার কোন অসুবিধা না থাকলে আমি একটু ওকে নিয়ে যাচ্ছি…!”
ফুপি বোকার মত তাকিয়ে রইলেন।আফনান জারাকে তাগাদা দিল-“তুমি তৈরী হয়ে এসো আমি ফুপির সাথে কথা বলছি”! আধাঘন্টার মধ্যেই জারাকে নিয়ে বেরিয়ে এল আফনান।ফুপি হাসি মুখে ওদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
ড্রাইভার চাচা গাড়ীর গেট খুলে দেবার সময় জারাকে সালাম দিলে জারা জিজ্ঞেস করল-“ভালো আছেন চাচা?”
-“জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ”!
গাড়ীতে আফনান কোনো কথা বলল না কেবল বাম হাত দিয়ে জারার ডান হাত ধরে রাখল যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে”!
জারা একটু ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল-“রাগ করেছেন?”
আফনান জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল-“খুব”!
জারা আর কিছু বলল না।গাড়ী থামলে জারা নেমেই চিনতে পারল এটা সেই হোটেল যেখানে জারার বিয়ে হয়েছিল।লিফট দিয়ে ওঠার সময়ও আফনান চুপ করে থাকল।তবে ওর হাত একমুহূর্তের জন্য ছাড়েনি।জারা লজ্জায় দুএকবার ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল আফনান মৃদু ধমক দিয়েছে-“কি শুরু করেছো?”
জারা ক্ষান্ত দিলো।
রুমে ঢুকে সাথে সাথেই বেলবয়কে নাস্তার অর্ডার দিয়ে দিলোআফনান।জারাকে বলল-“আমার জামা কাপড়গুলো একটু বের করতো,এগুলো পাল্টাবো।”আফনান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলে বাথরুমে চলে গেলল।জারা বোরকা খুলে আফনানের জিনিসগুলো গুছালো।ওর পড়ার মত হালকা পোষাক বের করে সামনে রাখল।
আফনান কোমড়ে টাওয়েল পেঁচিয়ে বেরিয়ে এল।ওর লোমশ ভেজা বুক পানিতে চকচক করছে।জারা ওর দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিল।আফনান ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের গা মুছল।জারা মুখ নামিয়ে রাখল।আফনান ওকে জিজ্ঞেস করল-“কি হয়েছে?”
-“কোথায় কি হয়েছে?”
-“নিচের দিকে তাকিয়ে কি দেখছো?”
জারা জবাব দিলোনা।গেট নক হলে জারা উঠে ভেতরের দিকে চলে গেলো।আফনান ততক্ষনে ঘরোয়া পোষাক পড়ে ফেলেছে।বেলবয় নাস্তা সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল।আফনান জারাকে ডাকল-“কই কোথায় গেলে?”
জারা এসে সামনে বসতে গেলে আফনান ওর হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসালো।তারপর বলল-“নাও শুরু করো “!
জারা ওর দিকে তাকাল-“আপনি কিছু বলছেন না যে?
কোনো প্রশ্নও করলেন না! কেন আমি এভাবে না বলে চলে এলাম’”!
আফনান চুপ থেকে বলল-“জারা,আমি গতকাল দুপুরে কানাডা থেকে এসেছি।৪৮ ঘন্টার প্লেন জার্নি,ট্রানজিট সব মিলিয়ে আরো কয়েক ঘন্টা। দেশে ফিরে দেখি বাসার এই পরিস্থিতি।রাতেই রওনা দিলাম।আর সকাল থেকে তো যা হচ্ছে তুমি দেখতেই পাচ্ছো।নিরিবিলিতে কথা বলার জন্যই তো এখানে এলাম।অবশ্য এমনিতেও রুম নিতে হতো,আমি আজই ঢাকা ব্যাক করতে চাইনি, কারন পরপর দুটো জার্নিতে এমনিতেই ভীষন টায়ার্ড লাগছে।ফুপির ওখানে কথা বলার মত পরিস্থিতি নেই,ফুপুকে এসবই বুঝিয়ে বললাম।তারপর তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম।গত পরশু রাতে প্লেনে বলতে গেলে ঘুমাইনি।গতরাতেও গাড়ীতে।দুরাতের ঘুম নষ্ট।কাল দুপুরেও কিছু খাইনি,রাতেও তেমন কিছু খাওয়া পরেনি।এখন বাজে সকাল আটটা।জারা দ্রুত একটা প্লেটে নাস্তা নিয়ে আফনানের হাতে দিল।আফনান প্লেট থেকে একটুকরো নিয়ে জারার মুখে দিয়েই সাথে সাথে বলল-“এই দাঁড়াও দাঁড়াও খেওনা।”
জারা ভাবল খাবারে কিছু আছে কিনা।সে ওভাবেই থেমে গেল,আফনান চট করে ওর মুখে মুখ লাগিয়ে খাবারটা নিজের মুখে যেন শুষে নিল।জারা ভীষন লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিল।আফনান হেসে ‘স্যরি’ বলে আরেকবার ওর মুখে খাবার তুলে দিল।নাস্তা পর্ব শেষে আফনান বললো,চলো বারান্দায় বসে কথা বলি।
চায়ের কাপ হাতে ওরা দুজনই বারান্দায় এসে বসল।তারপর আফনান চয়ে চুমুক দিয়ে বলল-“এবার বলো তো, কি হয়েছিলো সেদিন?কোনো কিছুই বাদ দেবেনা”!
জারা একটু চুপ থেকে বলতে শুরু করল।আফনানের বিদেশ চলে যাওয়া,ইরিনার ঘনঘন এ বাড়ীতে আসা,তারপর হঠাৎ ফোন কল,খুন হবার ভয় দেখানো,আম্মু্ সম্পর্কে সন্দেহ তৈরী করা।তারপর ড্রাইভার চাচাকে ধরে সেই দিনই সিলেট চলে আসা পর্যন্ত সবই বলল জারা।
আফনান চুপ করে গম্ভীর মুখে সব শুনল।
জারা জিজ্ঞেস করল-“আম্মু্ কেমন আছে?”
-তুমি চলে আসায় যথেষ্ট মুষড়ে পড়েছে।”
আফনান চিন্তিত মুখে পিরিচের ওপর কাপ ঘুরাতে লাগল।জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করল-“কে করেছে এসব?”
-“একজনকে সাসপেক্ট করছি কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে নাম বলতে চাচ্ছিনা।”আফনান ধীরে ধীরে বলল।তারপর জারার দিকে তাকিয়ে বলল-“আম্মু যে তোমাকে ওসব বলেছে তুমি তো আমার সাথে শেয়ার করতে পারতে”!
-“ছিঃ কেন! উনি আপনার মা।ওনার ছেলেকে হুট করে এভাবে কেউ দখল করে ফেললো,ওনার তো খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।সবার প্রকাশ ভঙ্গি তো আর একরকম হয়না।”
-“ইরিনার সাথে তোমার কথা হতো?”
-“না,ওনাকে ঠিক। বুঝতে পারিনা।
-“ইরিনা বাড়ীতে বলে বেড়াচ্ছে তুমি পালিয়েছো।”!
জারা চমকে ঠোঁটের ওপর হাত রাখল-“ইন্না লিল্লাহ”!
আফনান টাকাপয়সা চুরির কথাটা চেপে গেল।বলতে রুচিতে বাঁধছে।কেবল বলল-“ওকে একটা শিক্ষা দিতে চাই।”
জারা কিছুক্ষণের জন্য চুপ মেরে গেল।তারপর ধীরে আফনানের কাঁধে মাথা রেখে বলল-“আপনি আমাকে ভুল বুঝেননি এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।ওর জায়গাটা আমি নিয়ে নিয়েছি ওর খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।ও হয়তো আপনাকে ভালোবাসে…”!
আফনান জারার দিকে ফিরে তাকালো।আস্তে করে জিজ্ঞেস করল–“”আর তুমি? তুমি বাসোনা?”সে জারার দিকে তাকিয়ে রইল।জারা প্রবল আবেগে আফনানকে জড়িয়ে ধরল।ওর লোমশ বুকে মুখ ঘষে বলল-“বাসি,খুব ভালবাসি”!
আফনান উঠে দাঁড়িয়ে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।জারা নিজে আফনানকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
আফনান ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-“সেদিন কিন্তু তুমি প্রমিজ করেছিলে”!
জারা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।আফনান ওর নাকে আলতো কামড় দিয়ে বলল-“যেদিন খালামনিরা সবাই দাওয়াত খেতে এসেছিল”!
জারা নিঃশব্দে হাসল।আফনান ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-“প্রমিজ পুরো করার সময় এসেছে।”!
জারা ভীরু চোখে তাকাল আফনানের দিকে।-“আপনি ক্লান্ত, আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন।
-“হমম,চলো দুজনেই বিশ্রাম নেবো”!

আকাশ মেঘলা হয়ে এসেছে।শ্রাবনের বারিধারা নেমে আসতে পারে যে কোন সময়।এমন সময় আফনানের মোবাইল বেজে উঠল।জারা সেটা ধরতে বললে আফনান বালিশ ছুঁড়ে মারল মোবাইলের ওপর।বালিশের নিচে চাপা পড়ে গেল সেটা।
♥♥♥♥♥♥♥
….


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *