অর্ধাঙ্গিনী:৬ষ্ঠপর্বঃ

অর্ধাঙ্গিনী

৬ষ্ঠপর্বঃ
মোর্শেদা খাতুন।
♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪
আফনান বেশ অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলছে।জারা ড্রয়ার ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।ভাবছে,আফনানের মা যখন জানবে এ বিয়ের কথা,জারার কথা,সেটা কিভাবে নেবেন উনি!
তাছাড়া সেজানই বা কি করবে!! ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করল।হঠাৎ পেছন থেকে ওর কানে কেউ ফুঁ দিলে চমকে উঠল।তাকিয়ে দেখল আফনান হাসছে।জারার চেহারার বিষন্নতা দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল-“কোনো সমস্যা? কি হলো তোমার?এমন চাঁদমুখে অমাবশ্যার ছায়া কেন?”
জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“নাহ্,কিছু না”!বলে সরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালে আফনান চট করে ওর সামনে এসে পথ রোধ করল।-“অসম্ভব!কিছু তো হয়েছেই,তোমার মুখ বলছে সামথিং ইজ রং”!
জারা দ্বিধা করে শেষে বলেই ফেলল-“মা যদি আমাদের বিয়েটা মেনে না নেন?”
-“পাগল? মা মানবেই।সে আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।আমার খুশিই তার খুশি,ওটা নিয়ে ভেবোনা,ওটা আমার উপর ছেড়ে দাও”!
-“ইনশাআল্লাহ,বলুন! “
-” ইনশা..আল্লহ! “

বোরকা খুলে জারা অভিভূত হয়ে গেল।এতো সুন্দর আর প্রচুর ঢোলা।ঝরণার ধারার মত যেন হাত থেকে পিছলে পড়ে যেতে যায়।গাঢ় কফি কালারের উপর সেই রঙেরই মার্জিত কারুকাজ।জারা বোরকাটা গায়ে দিল,সাজবেনা ভেবেও হালকা করে লিপষ্টিক ছোঁয়াল।লোশন মাখতে যাবে তখনি শুনলো পেছন থেকে আফনান বলছে,”সোনার হাতে সোনার কাঁকন,কে কার অলংকার?”
জারা মৃদু হেসে লোশন মাখাতে লাগল হাতে গলায়।পায়ে দেবার জন্য ঝুঁকেছে তখনি আফনান ওকে থামিয়ে দিল-“আমি সাহায্য করছি।”
-“মানে?”
-“আরে মানে মানে কি?বসো এখানে” বলে বা হাতের তালুতে একগাদা লোশন ঢেলে নিলো আফনান।জারা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,”ইন্নালিল্লাহ,এত লোশন দিয়ে কি করবেন আপনি?”
আফনান জবাব দিলোনা কেবল ওর দিকে তাকিয়ে চোখ মারল।জারাকে বসিয়ে আফনান নিজেও ওর পায়ের কাছে বসল।তারপর দুহাত দিয়ে ওর পায়ের গোড়ালী থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত মেখে দিতে লাগল।”
জারা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।আফনান বলল-” —“পায়েই তো দিচ্ছি অন্য কোথাও তো দিচ্ছিনা,এত্ত অস্থির হচ্ছো কেন?আরে,লোশন মনে হয় বেশী হয়ে গেছে।”!
জারা মৃদু ধমকের সুরে বলল-“তখনি তো বললাম,দেখুন পায়ের অবস্থা, মাটিতে পা রাখলে স্লিপ করে পড়ে যাবো,ছাড়ুন তো! “
আফনান তবু মাখাতে লাগল-“আরে দাঁড়াও,ভালো করে মাখিয়ে দিলেই মিশে যাবে,হাঁটু পর্যন্ত দিতে হবে এই আরকি!”
জারা ছটফট করে উঠল-“ইয়াল্লাহ,সুড়সুড়ি লাগছে,ছাড়ুন..বলে পা ছাড়াতে গিয়ে বোরকার পিচ্ছিল কাপড়ে পেঁচিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল।আফনান সময়মতো ধরে না ফেললে কপাল ঠুকে যেতো মাটিতে।ওকে বাঁচাতে গিয়ে আফনান নিজেই মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে গেছে।জারা ওর গায়ের উপর পড়েছে বল ব্যথা পায়নি কিন্তু লজ্জায় এতটুকুন হয়ে গেল।আফনান দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে রাখল।জারা নিজের মুখটা আফনানের গলার কাছে লুকিয়ে রেখেছে।আফনান বুঝতে পারলো জারা একটু যেন কাঁপছে।ওর মুখ দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।জারা মুখটা গুঁজে রেখেছে।আফনান ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-“অজ্ঞান হয়ে গেছো নাকি আমার বুকে থাকার জন্য এটা চালাকি?”
জারা দ্রুত উঠে যেতে চেষ্টা করল কিন্তু কোনোভাবেই সুবিধা করতে পারলোনা!আফনান ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।বেশী নড়াচড়া করতে গেলে আরো বিশ্রীভাবে আফনানের গায়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।জারা দুহাত মাটিতে ঠেকিয়ে উঠার চেষ্টা করল-“ছাড়ুন না,উঠতে দিন,দেরী হচ্ছেনা?”
-” কিসের দেরী।থাকো না এভাবেই।জানটা ঠান্ডা হয়ে গেলো!”
জারা বলল-“আপনার মতলব দেখছি সুবিধের না,ছাড়ুন নাহলে কিন্তু ব্যথা পাবেন পরে আমাকে দোষ দেবেন না”!
-“ব্যথা? দাও ব্যথাই দাও,আর কিছু যখন পাবোনা……আ..আ..!” করে চিৎকার দিয়ে জারাকে ছেড়ে দিল।জারা ওকে ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়ল।আফণান উঠে বসে বাম হাত দিয়ে নিজের কাঁধ ডলতে লাগল-“ইসস, কামড় দিয়ে একেবারে মাংস নিয়ে নিয়েছো!”
জারা অদুরে দাঁড়িয়ে চোখে রাগ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।কিন্তু আফনানকে মলিন মুখে কাঁধ ডলতে দেখে এগিয়ে এল-“দেখি,খুব বেশী লেগেছে?”
আফনান মুখ গম্ভীর করে বসে কাঁধ ডলতে লাগল।মুখ দেখে মনে হলো প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে।ব্যথায় মুখটা বারবার কুঁচকে ফেলছে।জারা আর থাকতে পারলোনা,ওর কাছে গিয়ে ওর হাতটা সরিরিয়ে বলল-“দেখি,কোথায় লেগেছে?”
অমনি জারাকে বাগে পেয়ে আফনান ওকে পেঁচিয়ে ধরল-“এইবার? এইবার কোথায় পালাবে?”আফনান হাসতে লাগল।
-“তারমানে আপনি ব্যথা পাননি? মিথ্যে অভিনয় করছিলেন?”

  • “তোমার দাঁতে একদম জোর নেই।কামড় দিলে না আদর করলে?”
    -“আপনি একটা মহা অসভ্য, ছাড়ুন। “
    -“শোধ না নিয়ে ছাড়বো ভেবেছো?”
    জারা সরে যাবার চেষ্টা করল।আফনান ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-“যেখানে কামড় দিয়েছো সেখানে আদর করে দাও,তাহলে ছেড়ে দেবো!”
    জারা পীড়াপীড়ি করে একসময় ক্ষান্ত হলো।তারপর বাধ্য হয়ে কাঁধে হালকা করে ঠোঁট ছোয়ালো-” হয়েছে? “
    -“কামড় দিলে সর্বশক্তি দিয়ে আর আদর করলে জ্বরের রুগীর মত?”ওর কথা শুনে জারা হাসি চাপতে পারলোনা।খিলখিল করে হেসে উঠল।আফনান ওর হাসিটা দেখল কিছুক্ষণ।তারপর
    জারাকে শক্ত করে ধরে ওর কাঁধে নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিল।জারা নড়তে চেয়েও পারলোনা।সাঁড়াশির মত আঁকড়ে ধরে রেখেছে।জারার মনে হলো ওর কাঁধে আগুন লেগে গেছে।ও সর্বশক্তি দিয়ে আফনানের চুলগুলো মুঠো করে টেনে সরাতে চাইল।আফনানকে একচুল নাড়ানো গেলোনা।অবশেষে ফ্যাঁসফ্যাঁসে কন্ঠে বলল-“প্লিইজ! “
    আফনান ধীরে ধীরে মুখ সরিয়ে নিল।ওর মুখে হাসি।জারা কে ছেড়ে দিয়ে বলল- “শোধবোধ হয়ে গেল।”
    জারা লজ্জায় ওর দিকে তাকাতে পারছিলোনা।আফনান ওকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল-” যাও, তৈরী হও।”
    জারা ওর দিকে তাকালোনা, বোরকার নিকাব খুঁজতে লাগল।আফনান হঠাৎ নিজের সাদা শার্ট দেখিয়ে বলল-” এটা কি করেছো দেখো!”
    জারা দেখলো আফনানের ধবধবে সাদা শার্টে লালচে দাগের ছড়াছড়ি।মনে পড়ল ও সামান্য লিপষ্টিক ব্যবহার করেছিল।
    -“এটা আপনারই দোষ,গায়ে পড়ে লাগতে এসেছিলো কে?”
    -“লিপষ্টিক পড়ে আমাকে নিরব আহ্বান জানিয়ে ছিল কে?”আফনান পাল্টা জবাব দিল।”নিজের দোষটাতো দ্যাখো না”!
    -“অসভ্য কোথাকার,!ডাকাত “! জারা মৃদু স্বরে বলল।
    ♥♥♥
    কাল সন্ধ্যের ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে ওরা।তাই টুকটাক করে গোছানো শুরু করেছে জারা।আফনান ওকে নামিয়ে দিয়ে সেই যে বেরিয়েছে ফেরার নাম নেই!
    পুরোটা সন্ধ্যা জারা ফুপু আর বাবুর সাথে সময় কাটালো।ফুপু জারার কোলে বাবুকে দিয়ে উঠে বাথরুমে গেলেন!”
    জারা বাবুকে নিয়ে কতক্ষণ খেলা করল।তারপর ওর জন্য ফিডার বানাল।ফিডার খেয়ে বাবু ঘুমিয়ে পড়লে ওর জিনিসগুলো এক এক করে গোছাতে শুরু করল।রাত প্রায় বারোটা বেজে গেছে।ফুপু ঝিমাচ্ছে দেখে জারা ফুপুকে শুয়ে পড়তে বলে নিজের রুমে চলে এল।সাড়ে বারোটারও বেশী বেজে গেছে।চিন্তায় জারা ছটফট করতে লাগল।আফনানের সেল নম্বরটা পর্যন্ত ওর জানা নেই। অস্থিরতায় জারার দুচোখ দিয়ে পানি আসতে চাইছে।
    আফনান ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল।দুশ্চিন্তায় জারার মুখ শুকিয়ে গেছে।বারবার আল্লাহর কাঝে ওর সালামতির জন্য দুআ করছিল।
    এমন সময় বেল বাজল।জারা আইভিউ দিয়ে দেখে একটানে দরোজা খুলে ফেলল।আফনান ক্লান্ত বিধস্ত শরীরে রুমে ঢুকে গেট লাগাল।জারার চোখে পানি,আফনান ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল-“একি,চোখে পানি কেন?”
    -“আপনি সেই সন্ধ্যায় গেছেন।তারপর না ফোন না কোন খবর আমার বুঝি চিন্তা হয়না?”
    আফনানের মুখটা অন্যরকম আবেগে নরম হয়ে গেল-“আমার জন্য তুমি এত কষ্ট পেয়েছো?”
    জারা জবাব দিলোনা।ছুটে গিয়ে আফনানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।-“টেনশনে আমার কলিজা কাঁপছিলো”!
    -“দুর! পাগলি!”
    জারা মিশে গেল আফনানের বুকের সাথে।আফনান ওকে যেন বুকের সাথে পিষে ফেলতে চাইল।তারপর দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরল।জারা বাধা দিলোনা।বাইরে হঠাৎ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো।বাতাসের ঝাপটায় ঘরের ভেতরটা ভিজে যাচ্ছে।ওরা কেউই খেয়াল করছেনা।
    চলবে………

hassab_irsf


Comments

One response to “অর্ধাঙ্গিনী:৬ষ্ঠপর্বঃ”

  1. […] Chapter 1 Chapter 2 Chapter 3 Chapter 4 Chapter 5 Chapter 6 Chapter 7 Chapter […]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *