গল্প:- মৃত্যু তুল্য

গল্প:- মৃত্যু তুল্য
লেখক:- হাছাব বিন আহমেদ

রাত ১১টা বেজে ৩০ মিনিট, উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছি। এত রাতে ঠান্ডার মধ্যে উঠোনে বসে গল্প করছি।
কারণ আজ আমার বাসর রাত, বাসর রাত নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা থাকলেও বসে থাকতে হচ্ছে, উপায় নেই সবাই নতুন বউ দেখার জন্য আমার ঘর জুড়ে বসে আছে। আমি বেচারা বাইরে বসে সবার গল্প শুনছি।
রাত প্রায় ১২ টার দিকে অনেক কাংখিত বাসর ঘরে প্রবেশ করলাম।সুবহা খাটের উপর বসে আছে।জি আমার স্ত্রীর নাম সুবহা আর আমার নাম সজিব।সুবহার মুখের দিকে তাকালাম। ঘোমটা কিছুটা নেমে গেছে। দুজনেই নিরবতা পালন করছি।এই ঠান্ডার মাঝেও আমি ঘেমে যাচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে সুবহা বললো
সুবহা:-নার্ভাস লাগছে?এই নিন পানি খান।

সুবহার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেলাম। নতুন বউ এর দেওয়া জিনিস না নিলে কেমন হয়! আমি ওর দিকে তাকালাম। ভাল করে দেখার চেষ্টা করছি। টানা টানা দুচোখে কাজল দিয়েছে তাতে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ওই চোখের মাঝে নিজেকে হারাতেও কারো দ্বিধা থাকবে না। মুখের দিকে তাকিয়ে আছি কিছুক্ষণ। মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

এতক্ষণে নার্ভাস ভাবটা কেটে গিয়েছে। এক মুহুর্তে মেয়েটিকে খুব আপন লাগছে। সুবহা মুচকি হেসে বলল

সুবহা:-এভাবেই থাকবেন নাকি চেঞ্জ করবেন?
আমি:- আপনি চেঞ্জ করেন । আমি পরে করছি।
সুবহা:-ওকে।
সুবহা ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলাম। কারণ সে শাড়ি পরেছে, কিন্তু শাড়ির কুচি ঠিক হয়নি। হাসি থামানোর জন্য বলল
সুবহা:-এর আগে শাড়ি পড়িনি। কিভাবে কুচি দেয় সেটা পারিনা।
আমি:-সমস্যা নেই। আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
সুবহা:- আপনি?
আমি:-কেন আমাকে কি অকর্মার ঢেকি মনেহয়?
সুবহা:-তেমন না। তবে আপনি।
আমি:-এখানে আসেন ঠিক করে দেই।

সুবহার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিলাম। আমার সুন্দর করে শাড়ি পড়ানো দেখে সে অবাক। একটা ছেলে হয়েও এত সুন্দর শাড়ি পড়াতে পারি!
সুবহা:-আপনি এত ভাল শাড়ি পড়ানো কোথা থেকে শিখলেন? আগে কয়জনকে শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়েছন! হুম।
আমি:-কোন মেয়েকে পড়াইনি। তবে ছেলেকে পড়িয়েছি।
সুবহা:-মানে!
আমি:-কলেজে থাকা অবস্থায় আমরা নাটক করেছিলাম। তখন আমার এক বন্ধুকে সাজানোর জন্য শিখেছিলাম।
সুবহা:- আচ্ছা,প্রেম করেছেন কখনো? এযাবত কয়টা প্রেম করেছেন?
আমি:–একটা প্রেমও করি নি…
সুবহা:-মিথ্যা বলবেন না, মিথ্যা বলে লাভ নাই। যদিও করে থাকেন, তো এখন থেকে সব বাদ…
আমি:-আরে মিথ্যা বলব কেন, একটাও করিনি।
সুবহা:-আমাকে প্রশ্ন করলেন না? আমিই বলি… একটি করেছিলাম যখন যানতে পারলাম ইসলামে প্রেম হারাম তখন থেকে ছেড়ে দিয়েছি।

আমি আর তার কথাই মনযোগী হলাম না। আমি আমার মোবাইলটা নিয়ে মনযোগী হলাম। ভাবছি ফেইসবুক রিলেশনশিপ ষ্টাটাসটা পাল্টাবো, এই সময় একটি ফোন আসলো ফোনটা রিসিভ করা মাত্রই সুবহা ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে ফেলল।

সুবহা-দেখুন, ফোন আমারও আছে! কিন্তু আজকের জন্য সব বন্ধ। আর বলেছি না, আজকের পর থেকে সব প্রেম বাদ, সব মেয়ের সাথে কথা বলা বাদ।
ওযু করে আসুন, নামাজ পড়ব। তাছাড়া এশার নামাজও পড়া হয়নি। দুজনে একসাথেই পড়ব।
আমি:- জি এশার নামাজ আমারো পড়া হয়নি।

নামাজ শেষে দুজনা বিছানায় সামনাসামনি বসলাম। সে তার দু-হাত দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরে তার কোলে নিল। আমি চট করে হাতটা ছুটিয়ে নিয়ে, নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। সে আবার হেসে উঠল, আর হাতটা আবার ধরে টেনে নিয়ে বলল…

সুবহা:-ওমন করছেন কেন? আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়নি?
আমি:-হয়েছে…
সুবহা:-তো? তো, হাত সরিয়ে নিলেন কেন?
আমি:-এমনি, কখনো এভাবে কেউ হাত ধরেনি তো তাই…
সুবহা:-আমি আপনার বউ আর আপনি আমার স্বামী। আমাদের ধর্ম মতে, আমরা একে অপরের পরিহিত বস্ত্র সরূপ, বুঝেছেন?
আমি:-হুম…
সুবহা:-কচু বুঝেছেন! আপনি আপনার শরিরে যেভাবে পাঞ্জাবি পড়েছেন আমি আমার শরিরে যেভাবে শাড়ি পড়েছি আর অন্যান্য বস্ত্র পড়েছি, আমাদের সম্পর্কটা হল তেমন। আমাদের মাঝে কোন পর্দা নেই, কোন বাধা নেই। আপনি আমাকে যেমন খুশি ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারেন, তেমনি আমারও আপনার উপর অধিকার আছে যেমন খুশি ব্যবহার করার। এবার বুঝলেন?
আমি:-হুম বুঝেছি, আচ্ছা রাত তো অনেক হলো চলেন একটু ঘুমিয়ে নেই।
সুবহা:- জি।

আমি চুপ করে শুয়ে আছি। চোখে ঘুম নেই। সুবহার চোখেও এখন ঘুম নেই। আমার বুকে মাথা রেখে মনের কথাগুলো বলে যচ্ছে। আমি চুপ করে ওকে দেখছি। এমন একটা মেয়ের প্রেমে না পড়লেই নয়। নিজের অজান্তেই অনেক বেশি ভালবেসে ফেলেছি। এখন দুজনের কারো ঠান্ডা লাগছে না। প্রেমের উষ্ণতায় মিশে যাচ্ছি দুজন।
হঠাৎ কেউ আমাকে ডাকছে , চোখ খুলে দেখি সুবহা ডাকতেছে।

আমি:-কি হয়েছে ?
সুবহা:-কে যেনো দরজা খুলার জন্য ডাতেছে ,
আমি:- হুম ,খুলে দাও ।
সুবহা:- আমার শাড়ি খুলে গেছে , আসলে আমি শাড়ি পড়তে পারি না , শাড়ি পরে ঘুমালে শাড়ি আমার শরীরে থাকে না , এই অবস্থায় কিভাবে দরজা খুলবো ?

খেয়াল করলাম, আমিও হুমায়রার শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে গেছি।

আমি:- আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখতেছি !!(আমি)

আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম , ভাবিরা এসেছে। তাঁই আমি আর রুমে থাকলাম না । রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম।প্রায় ঘন্টা খানেক পর রুমে গেলাম সুবহাকে খাবার খাবার জন্য ডাকতে। দেখি সুবহা মন খারাপ করে বসে আছে।
আমি:- কি হয়েছে,মন খারাপ করে আছেন কেন? বাসর কথা মনে পরেছে??
সুবহা:- না
আমি:- তো কী হয়েছে?
সুবহা:- তখন ভাবীরা এসেছে আপনার বিষয়ে অনেক খারাপ করে বললো?
আমি:- কেন কি বলেছে শুনি?
সুবহা:- আপনার নাকি এখন অহংকার হয়েছে। আগে ভালোই ছিলেন,টাকা কামানোর পর থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলেন না। আরো অনেক কিছু বলেছে।
আমি:- তুমি এই গুলো নিয়ে মন খারাপ করে থেকো না প্লিজ । কে কি বললো তা নিয়ে যদি মন খারাপ করে বসে থাকো তাহলে তো আমারো মনটা খারাপ হয়ে যায়।
সুবহা:- জি
আমি:- তুমি কি জানো ভাবি কেনো এইরকম বলেছেন?
সুবহা:- না তো কেনো??
আমি:- কারণ ভাবি আমাকে তার সন্তানের থেকেও বেশি ভালো বাসে।
সুবহা:- মানে কি বুঝলাম না। আপনাকে এতো ভালো বাসে তাও আপনার বদনাম করলো ।তাও আমার সামনে?
আমি:- আচ্ছা তোমাকে শুরু থেকেই বলি। আমি তখন হায়রে সেকেন্ডারিতে পড়ি। আমার বেশিরভাগ সময় কাটাতো বড়ো ভাবির বাসায়। এমন কি বেশিরভাগ সময় ভাবির বাসায় খাবার খেতাম। তাঁর পর আমি ধীরে ধীরে ইসলামের পথে চলতে লাগলাম। এক সময় জানতে পারলাম ভাবির জন্য আমি মৃত্যু তুল্য। তাঁর পর ভাবির সঙ্গে প্রয়জন ছাড়া কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। সেখান থেকেই ভাবি আমাকে খারাপ পায়।
সুবহা:- কিন্ত কেন? ভাবির জন্য আপনি মৃত্যু তুল্য কেন??ভাবি তো মায়ের মতো!
আমি:- আচ্ছা বলছি শুনো
আমরা মনে করি ভাবি মায়ের মতো , দেবর ছোটো ভাইয়ের মতো । কিন্তু আমরা সবাই যদি চাঁদ কে সূর্য বলি তাহলে কি চাঁদ সূর্য হয়ে যাবে ? না । আমরা কি বলি তা দিয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই হয় না । আমরা যতোই ভাবিকে মা বলি ভাবি কখনো মা হয়ে যাবে না। আর দেবর কে ছোট ভাই মনে করলেই দেবর ছোটো ভাইয হয়ে যায় না । আমরা কি চিন্তা করি বা বলি তা দিয়ে ইসলাম চলে না । ইসলাম চলে তার নিজের নিয়মে।
দেবরের সামনে ভাবির পূর্ণ পর্দ করতে হবে। কথাটি খেয়াল করবেন আমি কিন্তু পর্দ করতে হবে তা বলিনি । আমি বলেছি সম্পূর্ণ পর্দা করতে হবে। কারণ আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ বলেছেন দেবর তো মৃত্যু তুল্য । তাঁর মানে মৃত্যু যতো ভয়ংকর তার তার থেকে বেশি ভয়ঙ্কর হলো দেবর। আপনি যে পরিস্থিতিতে থাকুন না কেন আপনাকে আপনার দেবরের সামনে সম্পূর্ণ পর্দা করতে হবে। আর একটি কথা পর্দা কোনো নফল ইবাদত না । এটা কিন্তু ফরজ । আশা করি বুঝতে পেরেছেন ।

তোমাকে তিনটি হাদিস বলি শোন।

(১)‘উকবাহ ইব্‌নু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মহিলাদের নিকট একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসার জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্‌র রসূল! দেবরের ব্যাপারে কি হুকুম? তিনি উত্তর দিলেন দেবর হচ্ছে মৃত্যুতুল্য। [মুসলিম ৩৯/৮, হাঃ ২১৭২, আহমাদ ১৭৩৫২] (আধুনিক প্রকাশনী- ৪৮৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮৫২)ফুটনোটঃ[২২] ———- শব্দের অর্থের ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী বলেছেন- ‘হামো’ মানে স্বামীর ভাই –স্বামীর ছোট হোক বা বড়। ইমাম লাইস বলেছেন- ‘হামো’ হচ্ছে স্বামীর ভাই, আর তার মত স্বামীর অপরাপর নিকটবর্তী লোকেরা যেমন চাচাত, মামাত, ফুফাত ভাই ইত্যাদি। বরং এর সঠিক অর্থে বুঝা যায় – স্বামীর ভাই, স্বামীর ভাই পো, স্বামীর চাচা, চাচাতো ভাই, ভাগ্নে এবং এদেরই মত অন্যসব পুরুষ যাদের সাথে এ মেয়েলোকের বিয়ে হতে পারে- যদি না সে বিবাহিতা হয়। কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এদের মৃত্যু বা মৃত্যুদূত বললেন কেন? এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছে –সাধারন প্রচলিত নিয়ম ও লোকদের অভ্যাসই হচ্ছে যে, এসব নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়। (এবং এদের পারস্পরিক মেলামেশায় কোন দোষ মনে করা হয় না) ফলে ভাই ভাইর বউ – এর সাথে একাকীত্বে মিলিত হয়। এভাবে একাকীত্বে মিলিত হওয়াকে তোমরা ভয় কর যেমনভাবে তোমরা মৃত্যুকে ভয় কর। আল্লামা কাযী ইয়ায বলেছেন – স্বামীর এসব নিকটাত্মীয়ের সাথে স্ত্রীর (কিংবা স্ত্রীর এসব নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে স্বামীর) গোপন মেলামেশা নৈতিক ধ্বংস টেনে আনে। ইমাম কুরতুবী বলেছেন- এ ধরনের লোকদের সাথে গোপন মিলন নীতি ও ধর্মের মৃত্যু ঘটায় কিংবা স্বামীর আত্মসম্মানবোধ তীব্র হওয়ার পরিণামে তাকে তালাক দেয় বলে তার দাম্পত্য জীবনের মৃত্যু ঘটে। কিংবা এদের কারো সাথে যদি জ্বেনায় লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে সঙ্গেসার করার দন্ড দেয়া হয়, ফলে তার জৈবিক মৃত্যুও ঘটে। আল্লামা তাবারী বলেছেন, যে কোন অপছন্দনীয় ব্যাপারকে আরবরা মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করত।সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫২৩২হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

(২)উকবাহ্‌ ইবনু আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ হুঁশিয়ার! (বেগানাহ) নারীদের নিকট তোমরা প্রবেশ করা পরিত্যাগ করো। সে সময় আনসারীদের এক লোক বলল- দেবর সম্পর্কে আপনার কি মতামত? তিনি বললেন- দেবর তো মৃত্যু তুল্য।(ই.ফা. ৫৪৮৭, ই.সে. ৫৫১১)সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৫৬৭হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

(৩)ইবনু ওয়াহ্‌ব (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ:ইবনু ওয়াহ্‌ব (রহঃ) বলেন, লায়স ইবনু সা’দ (রহঃ) -কে আমি বলতে শুনেছি যে, (–) শব্দের অর্থ স্বামীর ভাই (দেবর-ভাসুর) এবং স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তার (স্বামীর ভাইয়ের) সমপর্যায়ের চাচাত ভাই প্রমুখ। (ই.ফা. ৫৪৮৯, ই.সে. ৫৫১৩)সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৫৬৯হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
এখন বুঝতে পেরেছেন?
সুবহা:-জি বুঝতে পারছি। তো আপনি কথা গুলো ভাবিকে বুঝিয়ে বললেই তো হয়।
আমি:- আমি বুঝানর চেষ্টা করেছি কিন্তু ভাবি বুঝতে চাইনি। এখন এই দায়িত্ব তোমার। এখন এইসব বিষয় ছাড়ো ,চলো খাবার খাবো অনেক খুদা লেগেছে।
সুবহা:- জি চলেন।

………….. সমাপ্ত……………


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *