অর্ধাঙ্গিনীঃ
২য় পর্বঃ
মোর্শেদা রুবি
♥♪♠♪♥
গত কয়েকদিন যাবৎ সারা বেশীই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।তাই বাইরে বেরোতে পারছেনা।সেজানের নাম্বারে অনবরত কল দেবার পরও সে ফোন ধরছেনা এমনকি কল ব্যাকও করছেনা।এই ব্যাপারটা সারাকে আরো বেশী অসুস্থ করে ফেলেছে।সেজানকে সে অনেক বেশী বিশ্বাস করতো !কখনো মনে হয়নি ও সারাকে ধোঁকা দিতে পারে।সারা আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছে জারা আজকাল ওর সাথে কথা খুবই কম বলে। জরুরী দরকার ছাড়া কথা বলেনা।
সারা একদিন ওর হাত চেপে ধরল-“আপি,তুই খুব রাগ করেছিস,না?”
জারা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল-“আমার রাগে তোর কি যায় আসে?তোর যেটা ভালো লেগেছে, তুই করেছিস।কোনদিন আমার কোনো কথা শুনিসনি।আজ নিজেতো ডুবেছিস আমাকেও ডুবিয়েছিস!”
সারা মলিন কন্ঠে বলল-“আমিতো ওকে বিশ্বাস করেছিলাম আপি! আমার এমন কেন হলো! “
জারা রেগে বলল-“আগুনে হাত দেবার সময় যদি কেউ বলে আমিতো আগুনকে বিশ্বাস করেই হাত দিয়েছি তাহলে দোষটা কার? আল্লাহ কি আমাদের স্বাভাবিক জ্ঞান বুদ্ধি দেননি?বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা ইসলামে হারাম।তুই তোর দুনিয়া আখেরাত দুটাই নষ্ট করলি।বল্,তোর এই বাচ্চা কি পরিচয়ে বড় হবে? ওর তো কোনো দোষ নেই অথচ তোদের অপকর্মের শাস্তি ওকে পেতে হবে!কেন?
কখনো ভেবেছিস, লোকে আমাকে কি বলবে?বলবে ওর বোন এমন এমন কাজ করেছে।কেউ সমন্ধ নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেনা আর আমারো কোনোদিন বিয়ে হবেনা।বোন হয়ে তুই আমাকে এই উপহার দিলি?তাই না?”জারার চোখ পানিতে ভরে গেল।
.
সারা কিছু বলতে যাবে তখনি গেটের কাছে গাড়ীর হর্ণ শোনা গেল।সারা জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল এক দীর্ঘদেহী লোক গাড়ী থেকে নামছে।ওদের বাড়ীতেই ঢুকছে।
সারা ত্রস্তে জারাকে বলল-“এই আপি,কে জানি এসেছে! সেজানের ভাই নাকি এটা দেখ্তো!”
জারা চোখ মুছে উঠতে উঠতে বেল বেজে উঠলো।জারা দ্রুত ভেতর ঘরে চলে গেল।সারা মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে দরোজা খুলল।সালাম দিল।ভদ্রলোক দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে মার্জিত কন্ঠে বলল-“এটা কি “জারা বিনতে জামান” এর বাসা?
-“জ্বী,জ্বী……আমি জারা’পুর ছোটোবোন সারা।আপনি প্লিজ,ভেতরে আসুন ভাইয়া!”
-“আচ্ছা,আপনিই সারা? আমার নাম “জাওয়াতা আফনান”,আমি সেজানের বড় ভাই”!
-“জ্বী,ভাইয়া বুঝতে পেরেছি,বসুন ভাইয়া!”
-“আসলে,আমি তোমার বড় আপুর কাছে এসেছি।ওনার সাথে এক মিনিট কথা বলে চলে যাবো,আমার তাড়া আছে”!
-” আমি বলছি আপুকে, আপনি একটু বসুন না ভাইয়া!’
আফনান একটা সোফায় বসল।সারা ভেতরে দৌড় দিল।মিনিট দুইয়ের মধ্যেই একটা চওড়া নীল ওড়না দিয়ে হাতপা শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে জারা এলো।সে সোফায় বসলোনা,দুরে একটা ছোট টুলের উপর মুখ ঘুরিয়ে বসল!আস্তে করে সালাম দিলো।
আফনান ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।মুখ নিচু করে বলল-“দুঃখিত,অসময়ে বিরক্ত করার জন্য।আসলে আমি জানাতে এলাম যে আমি আমার মা’র সাথে কথাটা শেয়ার করেছি।তিনি যথেষ্ট আপসেট,সেজানের উপর প্রচন্ড রেগেও গেছেন।বুঝতেই তো পারছেন,তিনি সেজানকে খুব বকেছেন… এমনকি সম্পত্তি থেকে বেদখল করার হুমকিও দিয়েছেন বাট……..!” আফনান চুপ করে গেলো!”
জারা বলল-“কিন্তু…..কি? বলুন? তিনি কি সারাকে মেনে নিতে চাচ্ছেননা?
আফনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমি আসলে ওদের দুজনের সাথে পেরে উঠছিনা।মায়ের জেদ একদিকে আর সেজানতো……সেতো সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে সে নাকি সারাকে মেনে নেবেনা!ওর পক্ষে নাকি এমুহূর্তে তা সম্ভব না।তার সম্মান, সামাজিকতা…..!আরো যা যা বলেছে সেটা না শোনাই ভালো।”
.
জারা মুখ নিচু করে আস্তে করে চোখ মুছল।আফনান সেটা টের পেলো!অপরাধীর সুরে বলল-“দেখুন,আমি এটা নিয়ে খুবই রাগারাগি করেছি সেজানের সাথে,বকেছি,তাকে জোরও করেছি কিন্তু…..(আফনান থেমে গেল)তারপর আবার বলল-“আমি আপনাকে এটাই বলতে এসেছি যে আমাকে একটু সময় দিন।আমি সেজানকে প্রয়োজনে বাধ্য করবো,আর মা কেও বোঝাবো,আর সারার যাবতীয় খরচ আমাদেরই।
সেটা এনি হাউ সারার কাছে পৌঁছে দেয়া হবে….আপনি এতটা ভেঙ্গে পড়বেন না……!”
.
-“আপনার অনেক দয়া,অনেক কষ্ট করেছেন আমাদের জন্য কিন্তু আফসোস….আমরা উপকৃত হতে পারলাম না” দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথাগুলো বলল জারা।
.
আফনান কি বলবে ভেবে পেলোনা।জারা আস্তে করে উঠে পড়লে বলল-“চা দিচ্ছি, একটু বসুন”!
-“ওহ্,না না একদম সময় নেই।আমি বরং আসি,পরে যোগাযোগ করবো! যাবার আগে সারাকে দুটো কথা বলে যেতে চাই !”
.
জারা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল।প্রায় সাথে সাথেই সারা ঢুকল।সে গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।আফনান ওকে নিজের ফোন নম্বর দিলো আর যে কোন প্রয়োজনে ওকে বিনা সংকোচে জানাতে বলল, আরো কিছু টুকটাক কথা বলে সে চলে গেল।
…
দেখতে দেখতে মাসগুলো চড়ুই পাখির মত উড়ে উড়ে গেল।জারা বাবাকে সংক্ষেপে সব জানানো হলে তিনি তাড়াহুড়া করে দেশে চলে আসার প্রস্ততি নেন।
পরে সংবাদ আসে তিনি এয়ারপোর্টেই ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন,তাকে আরবের মাটিতেই দাফন করা হবে।সংবাদটা জারা দের কাছে পৌঁছালে ওরা দুবোনই পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ল।
.
ফুপির পরামর্শে সারাকে নিয়ে জারা সিলেটে চলে এলো।এখানে জারার বিধবা ফুপির এক বান্ধবী থাকেন।তার বাসার কাছে বাসা নিলো ওরা।ঢাকায় আত্মীয় স্বজনের নানান প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগবে,এখানে সেটা নেই।
সারা বলেছিল,আফনান ভাইয়াকে জানাই?
জারা রাগে বারণ করে দিয়েছে-“কোনো দরকার নেই!”
কিন্তু সারা গোপনে আফনানকে বিষয়টি ঠিকই জানিয়ে দিলো।
যথাসময়ে সারাকে সিলেটের একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হলো।দুশ্চিন্তায় জারার অসুস্থ হবার দশা।হাতে টাকাপয়সা ফুরিয়ে এসেছে।সারা চাকরী টিউশনি করে কিছু জমিয়েছিল আর আগে বাবা টাকা পাঠাতো এখন কি হবে!এখন তো সব পথ বন্ধ।এ দিকে সারার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার না।জারা চোখে যেন পথ দেখতে পাচ্ছেনা।নামাজে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলো।
.
সারাকে ওটিতে নেবার কিছুক্ষণ পর ডাক্তার জানালেন পেশেন্টের অবস্থা আশঙ্কাজনক।ভেতরে বাচ্চা ঠিকমত অক্সিজেন পাচ্ছেনা।বাচ্চাকে বাঁচাতে গেলে মাকে হারাতে হতে পারে।
দিশেহারা জারা মাকেই বাঁচাতে বলল।
ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার মলিন মুখে এসে এক ফুটফুটে শিশুর জন্মের এবং তার সাথেই বাচ্চার মায়ের মৃত্যু সংবাদটি দিলেন।
জারার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল।শিশুটিকে কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো জারা।ফুপিও নির্বাক হয়ে রইলেন।
এদিকে ক্লিনিকের মোটা অংকের বিল জমেছে।
.
এতোদিন সারা দেখে এসেছে এসব।
দিশেহারা জারা কেবিনে বসে আকাশপাতাল ভাবছে আর থেকে থেকে চোখের পানি মুছছে।এমন সময় নার্স এসে জানালো কাল দুপুর বারোটার মধ্যে কেবিন খালি করতে হবে।
জারা বলল-“মানে? আমরাতো এখনো বিলই দেইনি।
নার্স কাঠখোট্টার মতো বলল-“আপনাদের নতুন বাবুর বাবাই তো এসে বিল দিয়ে দিয়েছে!”
.
জারা বোকার মত তাকিয়ে রইল।নার্স বললো-“উনি বাইরে চাইল্ড স্পেশালিষ্টের সাথে কথা বলছেন,এলেই সব জানতে পারবেন!”
জারার ভেতরটা কষ্টে ফুঁসে উঠল।ভাবল-“আমার বোনের মৃত্যুর পর সেজানের আসতে ইচ্ছে হয়েছে?”
জারা কেবিনেই অপেক্ষায় রইল সেজানের।
এমন সময় গেটে নক হলে ফুপি উঠে দরোজা খুললেন।তার হাতে বাচ্চার ডাক্তারের ফাইল ধরিয়ে দিল কেউ একজন।ফুপি তা নিয়ে জারার হাতে দিলেন।জারা ঘোমটার আড়াল থেকে হাত বাড়িয়ে তা নিলো।
ফুপি বোধহয় ঐ সেজানকেই বসতে বলছেন-“বসুন,বাবা।”
জারা প্রস্তুতি নিলো সেজানকে কড়া কিছু বলবে।হঠাৎ ফাইলে বাচ্চার নামের নিচে গোটা অক্ষরে “জাওয়াতা আফনান” লেখা দেখে বিস্ময়ে মুখ ফিরিয়ে তাকালো চেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে।ভুলে গেল ওর মুখে কোনো পর্দা নেই,ওড়না সরে গেছে।তাকিয়ে দেখে সেজান নয় বরং আফনান অর্থাৎ সেজানের বড় ভাই বসে আছে।জারার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো।আফনান ওর দিকে চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে নিজেকে দ্রুত সামলে নিল।
জারাও মাথার ঘোমটা টেনে লম্বা করে বলল-“আ..আপনি?”।আফনান সামান্য কেশে নিয়ে বলল-“জ্বী,দুঃখিত পৌঁছুতে দেরী হহয়ে গেল।এখন চলুন, আমার সাথে” আপনার ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে নিন!”
জারা পাথরের মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।কোনমতে বলল-“মানে?কোথায় যাবো আমি?”
আফনান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-“আমার বাড়ীতে”!
জারা মুখ ঘুরিয়ে সেই অদ্ভুত চোখে তাকালো-“আপনার বাড়ী?কেন?আর কিসের অধিকারে?আপনার বাড়ীতে আমি কেন যাবো?”
আফনান একবার ওর ফুপুর দিকে তাকালো।
তারপর জারার দিকে তাকিয়ে স্থির বিশ্বাসে ধীরে ধীরে বলল-“সেখানে যাবেন আমার অর্ধাঙ্গিনীর অধিকারে…….সসম্মানে! “
..
চলবে…..
Leave a Reply