অর্ধাঙ্গিনীঃ৩য় পর্ব
৩য় পর্বঃ
মোর্শেদা খাতুন
.
আফনানের কথায় মনে হলো যেন ঘরের মধ্যে বাজ পড়েছে।
পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে।জারা মাথা নিচু করে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে চুপ করে।বাচ্চাটা মিহি শব্দেওঁ..ওঁ…করছে।ফুপু একবার জারাকে দেখছেন আরেকবার আফনানকে দেখছেন।
.
আফনান কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল যেন জারা কিছু বলতে পারে।কিন্তু জারাকে একেবারে নিশ্চুপ দেখে সে উঠে দাঁড়ালো।
সামান্য কেশে স্পষ্ট ভাবে বলল-“আমি জানি আপনি অনেক বড় একটা ভাবনাতে পড়ে গেছেন।প্রত্যেক মেয়েরই নিজস্ব কিছু স্বপ্ন থাকে,আপনারও থেকে থাকবে।জানিনা, আমার এই প্রস্তাবকে আপনি কি চোখে দেখছেন।শুধু এটুকু বলতে পারি,বিষয়টাকে অন্যভাবে নেবেননা প্লিজ।আপনাকে দয়া দাক্ষিণ্য কোনটাই করতে আসিনি আমি।বাচ্চাটা আমাদের বংশের সন্তান।জেনেশুনে তো এটাকে অগ্রাহ্য করতে পারবোনা !”!
.
জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমার যে কি করা উচিৎ কেউ একটু বলে দেবেন?আমি স্থিরভাবে কিছু ভাবতে পারছিনা।বাচ্চাটাকে আপনাকে দিয়ে দিলে আমি নিজেও খুব একটা স্বস্তি পাবোনা।তাছাড়া ও আমার সারার সন্তান।আবার মন থেকে এটাও মেনে নিতে পারছিনা কেবল বাচ্চাটার জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছেন!!”
.
আফনান ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দুহাত পকেটে পুরে দিয়ে বললো-“বাধ্য হচ্ছি বলতে কি বুঝাচ্ছেন? আমাকে কে বাধ্য করবে?
জারা দেবার মত কোনো উত্তর খুঁজে পেলনা।
আফনান অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে উঠল- “আমি কিন্তু প্রথমেই বলেছি আমি কোনোভাবেই আপনার প্রতি দায়বদ্ধ নই।হ্যাঁ,বাচ্চাটা আমাদের দায়িত্ব যেটা আমি কখনোই অস্বীকার করিনি।”
.
-“তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনে আপনার ইন্টেনশনটা কি?(জারা মৃদু শব্দে বলে একটু চুপ থেকে বলল)-“আমি…আ..আমিতো কোনোভাবেই আপনার উপযুক্ত বা সমকক্ষ নই!”
আফনান নিরবে তাকিয়ে থাকল জারার দিকে।পাশ থেকে ওড়নার আড়ালে ওর ভারী খোঁপাটা চোখে পড়ছে।
আফনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমার উপযুক্ত হতে হলে কি কি থাকতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
মনে মনে কিছুটা তেতে উঠল আফনান,’আর কিভাবে বললে তুমি বুঝবে যে আমি তোমাকেই চাইছি,সেই প্রথম দিনেই বাধা পড়ে গেছি তোমার কাছে”!
কিন্তু মুখে শান্তভাব বজায় রেখে বলল-“তাছাড়া বাচ্চাটা আপনার কাছেই ভালো থাকবে।আপনি ওর খালামনি হন, আপনার চে বেশী আর ওকে কে ভালবাসবে বলুন ?”
- আপনিও তো ওর চাচা হন!
আফনান কোনোকিছু না ভেবেই বলে বসল-“বাচ্চাটাকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা আর যত্ন দিতে ওর একজন মা প্রয়োজন যেটা আপনি দিতে পারেন।তাই খালাকেই চাচীর স্থানে বসাতে চাচ্ছি”!
মনে মনে ভাবছে আফনান-“আর কত ধৈর্য্য পরীক্ষা নেবে জারা?”
জারা ভাবছে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা।ওর বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এটা নিঃসন্দেহে বিরাট একটা লোভনীয় প্রস্তাব কারন সে নিজে আজ অভিভাবকহীন একাকী।
সে একটু থেমে বলল-“সেজান আর আপনার মা??”
.
আফনান মাথাটা সামান্য কাত করে কপালটা চুলকে বলল-“এটা একটা ভাইটাল কোশ্চেন।তবে আমি এটা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নই।তাছাড়া আপনাকে তো আরেকটা কথা বলাই হয়নি,’সেজান কিছুদিন আগে মারাত্মক ভাবে ইনজিওরড হয়েছে একটা কার এক্সিডেন্টে! সেখানে ওর গাড়ী ছ ফুট নিচু খাদে পড়ে যায়!ওর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল।পরে ওকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানো হয়েছে বাট…ওর পুরোপুরি সেরে ওঠার সম্ভাবনাও অনেক কম।যদি সেরে ওঠেও তবু সে কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে কিনা এ ব্যপারে ডাক্তারদের আশংকা রয়েছে !আমার আম্মা ওর সাথে আছেন সেখানে।’
আসলে আপনাকে অনেক কথাই বলার ছিল, কিন্তু সময় বা পরিস্থিতি কোনোটাই অনুকূলে নয়।তাই কেবল এতটুকুই বলব বাচ্চাটার স্বার্থে হলেও আমাদের এক হওয়া উচিত।
আপনি যাবার বিষয়টি বিবেচনা করবেন আশাকরি।
আমি আজ আসি ,যদি রাজী থাকেন তো কাল সকাল এগারোটার দিকে গাড়ী পাঠিয়ে দেবো,চলে আসবেন। আর হয়ত কাল রাতের ট্রেনেই ঢাকা ব্যাক করবো।আমি নিজেই আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি থাকলে আপনি হয়ত অস্বস্তি বোধ করতে পারেন,তাই…..”!
.
আফনান চলে যাবার জন্য দুপা এগিয়ে আবার ফিরে এলো-“আপনার অমত না থাকলে কালই আমাদের বিয়েটা হবে,ইনশাআল্লাহ।কারন,আপনার সম্পর্কে যতদুর জেনেছি,গায়ের মাহরামের সাথে আপনি সহজ হতে পারবেন না।আর আমি নিজেও চাইনা আপনি একটা মুহূর্তও কোনো পরপুরুষের সাথে সময় কাটান।
আর একটা কথা, আপনাকে পছন্দ না হলে গায়ে পড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার মত অতটা উদার বোধহয় আমি নই।অবশ্য তারমানে এটাও না যে আমি আপনার ওপর স্বামীত্বের অধিকার খাটাবো! এটা আমার একতরফাই থাক।এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।আপনি নিজে মন থেকে আমাকে মেনে না নেয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে বিরক্ত করবোনা।”
আর…..আর একটা কথা,পরিস্থিতির কারনেই আপাতত চাচ্ছিনা মাকে বিয়ের কথাটা জানাতে।কিছুদিন পর তিনি দেশে ফিরলে তাকে আমিই জানিয়ে দেবো।এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন।এই যে কার্ডটা এখানে রেখে গেলাম।(ফুপুর দিকে একটা কার্ড বাড়িয়ে ধরল)আমার ফোন সারারাত আপনার ফোনের অপেক্ষা করবে।আসি।”
বলে আফনান আর দাঁড়ালো না।
.♥.
আফনান চলে যাবার পর জারা বাচ্চাটাকে আলতো করে শুইয়ে দিলো।ওর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।ফুপু ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন-“শোনরে মা,আল্লাহ তো তোকে সম্মাণিত করেছেন।বাচ্চার চাচার প্রস্তাবটা তোর জন্য আল্লাহর রহমত হয়ে এসেছে।কেন এটাকে ঠুকরাচ্ছিস।রাজী হয়ে যা।ছেলেটা খুব ভালো দেখেই মনে হচ্ছে।মাগো! চুল তো আর বাতাসে পাকেনি,লোক চিনতে এখন আর ভুল হয়না”!
.
রাত প্রায় বারোটা।বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। ফুপুও অপর বেডে ঘুমাচ্ছেন কেবল ঘুম নেই জারার চোখে।ইস্তেখারার নামাজ শেষে মনটা হালকা লাগছে।সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হয়েছে।মনে পড়লো আফনানকে ওর সম্মতির কথাটা জানাতে হবে।এত রাতে ফোন দেবে কিনা ভেবে ভেবে কল দিয়ে ফেলল।রিং ঠিকমতো হয়ওনি অমনি কট করে রিসিভ করে ফেলল আফনান।যেন ফোন হাতে নিয়েই বসেছিল।
ভারী শব্দে বলল-“জ্বী বলুন”!
জারা ইতস্তত করে বলল-“জ্বী….গাড়ী ক’টায় আসবে?”
আফনান লাফ দিয়ে বিছানার উপর উঠে বসে ডানহাতটা সজোরে মুঠো করে ঝাঁকালো,মনে মনে বলল-“ইইইয়েসসস!”
ফোনে খুব শান্ত ভঙ্গিতে বলল-“এই ধরুন,এগারোটা কি সাড়ে এগারোটার দিকে ? ঠিক আছে?”
জারা মৃদু শব্দে বলল-“হমম”!
-“আপনার ফুপুকেও নিয়ে আসবেন।আমি চাই বিয়েতে তিনিও থাকুন!”
-“ফুপু গেলেও রাতে চলে আসবে উনি ঢাকা যাবেননা”!
-“আচ্ছা,ঠিকআছে।ছাড়ি তাহলে?আর একটা কথা!
,-“জ্বী বলুন!”
-“আফনান ভারী কন্ঠে বলল-“থ্যাংকস!”
-“থ্যাংকস না,বলুন,যাজাকাল্লাহ।”
-“যাজাকাল্লাহ”!
জারা ফোন নামিয়ে চেয়ে রইল বাচ্চার দিকে।
.
.♪♪..♥♪♪
পরদিন ঠিক এগারোটার সময় গাড়ী চলে এলো!ড্রাইভার নিজেই মালপত্র গাড়ীতে তুলল।ফুপু বাচ্চাটাকে নিজের কোলে রেখেছেন।ড্রাইভার গাড়ীর দরজা খুলে সরে গেছেন।জারা নিঃশব্দে উঠে বসল।
আধাঘন্টার মধ্যেই বিলাসবহুল একটা হোটেলের সামনে গাড়ী পার্ক করলো”!”বোরকা পড়া জারার নিজেকে এখানে অনাহুত মনে হতে লাগল।একজন নারী পোর্টার এসে সালাম দিয়ে সসম্মানে জারাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।দুটো কামরা বুক করা হয়েছে,একটা জারা আর ফুপুর জন্য অন্যটা আফনানের।
.
সারাদিনে আফনান একবারো দেখা করলোনা।সন্ধ্যের সময় একজন মহিলা এসে জারাকে কিছু প্যাকেট দিয়ে গেল।সাথে একতোড়া ফুল আর একটা চিরকুট।
জারা চিরকুট খুলে দেখলো তাতে লেখা-“সারাদিন ইচ্ছে করেই আসিনি,ভেবেছি বিশ্রাম নেবেন।সাথে দেয়া প্যাকেটগুলোতে কিছু জামাকাপড় আছে।পছন্দ হবে কিনা জানিনা,এক বন্ধুর স্ত্রীকে দিয়ে কিনালাম।ওগুলো পরে নেবেন।রাতে একেবারে কাজী নিয়ে আসবো।ভালো থাকবেন।’
.
জারা প্যাকেটগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো,তাতে দামী শাড়ী এবং হালকা গহনা রয়েছে।জারার এবার সত্যিই লজ্জা করতে লাগল।কোনোদিন ভাবেনি এভাবে অচেনা লোকদের মাঝে ওর বিয়ে হবে!
.
সন্ধ্যের দিকে জারা মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠতেই গেটে নক হলো! গেট খুলতেই দেখলো দুজন মহিলা।যাদেরকে সারা চেনেনা।তারা সালাম দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিল,তাদেরকে পাঠানো হয়ছে।তারা বৌ সাজাতে এসেছে।জারা কিছুটা বিরক্ত হলো, কি এক বিয়ে তার আবার সাজ!! আফনানকে বারকয়েক ফোন দিল জারা। কিন্তু আনরিচেবল আসছে।
.
অগত্যা জারাকে মেকাপ নিতে হলো।ওরা চুল বেধে একেবারে ভারী লেহেঙ্গাটা সুন্দরভাবে পড়িয়ে দিয়ে গেল।জারা চুপচাপ বসে ওদের কাজ দেখতে লাগল।বাচ্চাকে ফুপিই টেক কেয়ার করছে।সাজ শেষ হলে ওরা বলল-“ম্যাম দেখুন তো ঠিকআছে কিনা?”
জারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরে আয়নায় তাকাল।মনে মনে বেশ চমকে উঠল-‘ওরে বাবা,ওকে তো চেনাই যাচ্ছেনা।’
.
রাত নটার দিকে আফনান এল।ওর সাথে দুতিনজন ঘনিষ্ট অতিথি।ফুপুর বান্ধবীও এসেছে পরিবার নিয়ে।তিনিও আমন্ত্রিত। এসব নিশ্চয়ই আফনানের কাজ।এত হুলুস্থুলের কি দরকার ছিল?
.
পরের ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে গেল।বিয়ে পরানো হয়ে গেলো।সবাই মিষ্টি মুখ করলেন।অতিথিদের সবাইকে খাবারের জন্য ডাইনিং হলে নিয়ে যাওয়া হল।ফুপুও গেলেন।আফনান সবাইকে পঠিয়ে বলল-“আপনারা যান আমি একটু পর আসছি।”!
.
জারা সোফায় চুপটি করে বসে আছে।আফনান ওর কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে কার্পেটে বসে বলল-“কি ভাবছেন?”
জারা মাথা নাড়ল’না,কিছুনা!”।
আফনান একটু হেসে বলল-“এখনতো আমি আর পরপুরুষ নই,ঘোমটাটা সরিয়ে কথা বললে ভালো হতোনা?আমি নিজেই সরাতাম আবার এটা ভেবে না বসেন স্বামীত্বের অধিকার ফলাতে এসেছি।”
.
আফনানের কথা শেষ হবার আগেই জারা আফনানের পাশে কার্পেটে বসে পড়ল।মেহেদীরাঙা জড়োয়া গহনায় ঢাকা ডান হাতটা দিয়ে আফনানের পা ছুঁলো!”
আফনান ওর হাত ধরে ফেলল-“এটা কি হলো?”
-“পা ছুঁয়ে সালাম করলাম, যেভাবেই হোক,আপনি আমার স্বামী।মাথা না নুইয়ে এভাবে সালাম করার অনুমতি ইসলামে আছে!”
.
আফনান দুষ্টামীর ছলে বলল-“ওও…..তা আমিও কি তাহলে ছুঁতে পারবো?মানে আমার তো অনুমতি আছে?”
জারা মাথা সোজা করে ওর দিকে তাকালো, অমনি ঘোমটাটাও খসে গেল।আফনান কথা ভুলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“মাশাআল্লাহ”!
.
জারা হাসি চাপতে দ্রুত মুখ নামিয়ে নিল।আফনান মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।জারা নিরবতা ভেঙ্গে বললল-“দুজনই এভাবে ফ্লোরে বসে আছি,চলুন উঠি”!
দুজনই একসাথে উঠতে গেলে জারা ভারী লেহাঙ্গায় পা বেঁধে আফনানের গায়ের ওপর পড়ে যেতে নিল।আফনান দ্রুত ওকে ধরে ফেলল-“আরে সাবধানে”! হাঁটতে কষ্ট হলে বলুন,কোলে করে নিয়ে যাই”!
জারা ত্রস্তে সরে দাঁড়ালো-“আরে না না।”!
আফনান হেসে ফেলল-“ভয় পাবেননা।আপনার অনুমতি ছাড়া আপনাকে ছোঁবোনা,আপনি কিন্তু অলরেডী আমাকে দুবার ছুঁয়ে ফেলেছেন।
এটা কিন্তু চিটিং।”!
.
জারা এবার হেসেই ফেলল।আফনান সেদিকে তাকিয়ে মৃদু শব্দে বলল-“উফ,পাগল হয়ে যাবো”!
……
চলবে…..
Leave a Reply